দেশের আলো রিপোর্ট
২০০১ থেকে ২০২০ এর ১৬ জুন। দিন গিয়ে মাস, মাস গিয়ে বছর পেরিয়ে গেল যুগ। এভাবেই ১৯টি বছর পেরিয়ে ২০ বছর শুরু। কিন্তু আজো বিচার কার্য সম্পন্ন হয়নি নারায়ণগঞ্জের চাষাঢ়াস্থ আওয়ামী লীগ অফিসে বোমা হামলা ঘটনার অভিযুক্তদের। শক্তিশালী বোমার আঘাতে
নির্মম মৃত্যু ঘটে ২০টি তাজা প্রাণের। এখনো থামেনি নিহতের স্বজনদের আহাজারী। ক্ষত বিক্ষত করা শরীরের বিভিন্ন স্থানে স্প্রিন্টার এখনো যন্ত্রনা দেয় নৃশংস ওই বোমা হামলায় আহতদের। নিহতদের স্বজনদের বুকভরা আশা ছিল আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে মামলাটির সুষ্ঠু সমাধান হবে, উচিত শাস্তি পাবে প্রকৃত দোষীরা। তবে অভিযুক্তদের কেউ কেউ এখনো উন্মুক্ত ঘুরছে। এ নিয়ে স্বজনদের ক্ষোভ।
ফলশ্রুতিতে আজও অপেক্ষায় প্রহর গুনছে কবে শেষ হবে নারকীয় এ হত্যাযজ্ঞের মামলা। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক নিহতদের পরিবারের কয়েকজন স্বজন জানান, ঘটনার পর নিহতদের পরিবারের পক্ষ থেকে কোনও প্রকার মামলা করা হয়নি। তাদেরকে মামলা করতেও দেয়া হয়নি। এ ঘটনায় আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে বিএনপির ২৭জনকে আসামি করে মামলা করা হয়। পরে বিএনপি সরকার ক্ষমতার আসার পর আওয়ামী লীগ নেতাদের বিরুদ্ধে মামলা করে। এভাবে বোমা হামলার ঘটনা নিয়ে একে অন্যের সঙ্গে দড়ি টানাটানি খেলায় মেতে ওঠে দুই দল। সর্বশেষ গত ১১ মার্চ এ হামলার ঘটনায় ৯ জনের সাক্ষ্যগ্রহণ হয়েছিল। সকাল থেকে দুপুর পর্যন্ত নারায়ণগঞ্জ অতিরিক্ত জেলা ও দায়রা জজ শাহ মোহাম্মদ জাকির হোসেন এর আদালতে জামিনপ্রাপ্ত ও কারাবন্দি আসামীর বিরুদ্ধে সাক্ষ্য গ্রহণ হয়। যারা স্বাক্ষী দিয়েছিলেন তারা হলেন ফারুক, হুমায়ুন হামিদ, বীর মুক্তিযোদ্ধা সৈয়দ লুৎফর রহমান, মোকারম হোসেন, খালিদ হাসান, হুমায়ুন কবীর, ফরিদ উদ্দিন, তানজিলুর রহমান ও শফিকুজ্জামান । এ পর্যন্ত সর্বমোট ১৬ জন সাক্ষীর স্বাক্ষ্য গ্রহণ করা হয়েছে। ওইদিন হাজির করা হয়েছিল এ বোমা হামলা মামলার আরেক আসামি শাহাদাৎ উল্লাহ জুয়েলকে।
এছাড়াও অভিযুক্ত ৬ আসামীর মধ্যে নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশনের ১২নং ওয়ার্ড কাউন্সিলর শওকত হাশেম শকু (জামিনপ্রাপ্ত) ও যুবদল নেতা
ক্রস ফায়ারে নিহত মমিন উল্লাহ ডেভিডের ছোট ভাই শাহাদাৎ উল্লাহ জুয়েল (কারাগারে বন্দি) উপস্থিতিতে স্বাক্ষ্য গ্রহণ হয়েছিল। ভয়াবহ সে কাল রাত ২০০১ সালের ১৬ জুন শনিবার বিকাল থেকেই চাষাঢ়াস্থ শহীদ মিনার সংলগ্ন আওয়ামী লীগ অফিসে তৎকালীন এমপি শামীম ওসমানের
গণসংযোগ কর্মসূচিতে দলের সাংগঠনিক কর্মকান্ডে জড়িত নেতৃবৃন্দরা জড়ো হতে থাকেন। রাত ৭টার মধ্যে পুরো অফিস লোকে লোকারণ্য হয়ে পড়ে। কিন্তু তারা কেউ জানতেন না যে, তাদের প্রাণের স্পন্দন কেড়ে নিতে অথবা কারো অঙ্গহানি করার জন্য সেখানে রাখা হয়েছে শক্তিশালী বোমা। হলরুমের একেবারে দক্ষিণ দিকে ফতুল্লা- সিদ্ধিরগঞ্জ আসনের সাংসদ শামীম ওসমান বসে এলাকার মানুষের কথা শুনছেন। একেকজন একেক সমস্যা নিয়ে আসছেন। কারো চাকরির সুপারিশ, কারো চিকিৎসা সংক্রান্ত তদবির, কারো ভর্তির সমস্যা। হলরুম পার হয়ে একটি কক্ষ। সংসদ সদস্য শামীম ওসমানের খাস কক্ষ। হলরুমের পরের ঘরটিতে তখন আলোচনায় বসেছিলেন দেওভোগ, নারায়ণগঞ্জ ইউনিয়ন এবং নারায়ণগঞ্জ জেলা আওয়মী লীগের বেশ কয়েকজন নেতা। যেখানে তখন উপস্থিত ছিলেন, এড. খোকন সাহা, রফিক, তৎকালীন চাষাঢ়া ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সভাপতি কামাল আহম্মেদ (প্রয়াত), সহ-সভাপতি বীর মুক্তিযোদ্ধা সৈয়দ লুৎফর রহমানসহ আরও কয়েকজন নেতৃবৃন্দ। কয়েক দিন পরেই নারায়ণগঞ্জের দেওভোগে জনসভা করবেন শামীম ওসমান। সভার আলোচনা প্রায় শেষ পর্যায়ে। সভা শেষ করার কথা শামীম ওসমানের। কিন্তু মানুষের কথা শুনতে শুনতে উঠে আসতে পারছিলেন না তিনি। তাই ফোন করে আনালেন তার পিএস, কৃষক লীগ নেতা চন্দন শীলকে। চন্দন শীলকে দায়িত্ব দেয়ার পর তিনি ভেতরে ঢুকছিলেন সভায় যোগ দিতে। শামীম ওসমান ওঠার পরপরই রাত পৌনে
৯টায় এতক্ষন তার বসে থাকার স্থানের অদূরেই বিকট শব্দে বিস্ফোরণ ঘটে শক্তিশালী বোমার।কৃত্রিম পায়ে ভর করে মামলার দ্রুত নিস্পত্তি এবং দোষীদের শাস্তির অপেক্ষায় চন্দন শীল বোমা হামলার শিকার হয়ে মৃত্যুর দুয়ার থেকে ফিরে এসেছেন ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির নারায়ণগঞ্জ জেলার সভাপতি চন্দন শীল। কিন্তু পা দু’টি সারা জীবনের জন্য হারাতে হয়েছে। হাঁটুর ওপর থেকে দু’টি পাই কেটে ফেলতে হয়েছে। কৃত্রিম পা নিয়ে কোনোমতে চলাফেরা করেন। তিনি বলেছেন, মৃত্যুকে খুব কাছ থেকে উপলব্ধি করেছি, তাই মৃত্যুকে আর ভয় পাই না। যারা চাষাঢ়াসহ সারাদেশে এ বর্বরোচিত বোমা হামলা চালিয়েছে, আমৃত্যু তাদের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করে যাব। বোমা হামলার মামলাগুলোর অগ্রগতি হয়েছে এটা ভালো । তবে
মামলাটির দ্রুত নিস্পত্তি এবং দোষীদের কঠোর শাস্তি চাই। মৃত্যু যন্ত্রনা কতটা ভয়াবহ অনুভব করেছি বোমা হামলায় আহত তৎকালীণ চাষাঢ়া ইউনিয়ন আওয়ামী লীগ সহ- সভাপতি মুক্তিযোদ্ধা সৈয়দ লুৎফর রহমান সেদিনের ঘটনার স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে বলেন, মৃত্যু যন্ত্রনা কতটা যে ভয়াবহ তা প্রতিটামুহুর্তে অনুভব করেছি। এখনো স্প্রিন্টার আঘাতের ব্যথা যন্ত্রনা দেয়। সেদিন রাত তখন ৮টা ৪৫ মিনিট। বিকট শব্দ। তারপর আমি আর কিছুই বলতে পারবো না। পরে জানতে পারি বোমা বিস্ফোরণে প্রায় ২০ মিনিট ওইখানেই পড়েছিলাম। আমার শরীর থেকে রক্তক্ষরণ হচ্ছিল। এরপর আমার আত্মীয় রফিক আমাকে গাড়িতে করে তৎকালীণ ২০০ শয্যা (বর্তমানে ৩০০ শয্যা) হাসপাতালে পাঠায়। পরে আমার বড় ভাই মোতালিব হোসেন আমাকে নিয়ে ছুটাছুটি করে। তখনও আমি অজ্ঞান। বর্তমান মহানগর আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতি রবিউল হোসেন আমার বাসায় খবর পাঠায়। সেদিন ২০টির বেশি স্প্রিন্টারের আঘাতে মাটিতে লুটিয়ে পড়ি। একেকটি স্প্রিন্টার যেন রাইফেলের একেকটি গুলির মতো। দুইদিন পর আমার জ্ঞান ফিরে আসে। যখন জেগে উঠি তখন দেখি আমার ডান পার উপরের অংশ থেকে অনবরত রক্ত বের হচ্ছে। এরপর দীর্ঘ তিন মাস হাসপাতালে থাকতে হয়। শরীরে অসংখ্য স্প্রিন্টার নিয়ে এখনো বেঁচে আছি শুধু ওইসব হামরাকারীদের বিচার দেখে যেতে চাই বলে।
সেদিন শক্তিশালী বোমা বিস্ফোরণে যারা নিহত হয় বোমা বিস্ফোরণে মুহূর্তেই ছিন্ন ভিন্ন হয়ে যায় সেখানে উপস্থিত অসংখ্য ব্যক্তির দেহ। এদের মধ্যে একজন নারীর পরিচয় এখনও জানা যায়নি। নিহতরা হলেন, শহর ছাত্রলীগের সভাপতি সাইদুল হাসান বাপ্পী, সরকারি তোলারাম কলেজ ছাত্র-ছাত্রী সংসদের জিএস আকতার হোসেন ও সঙ্গীত শিল্পী মোশাররফ হোসেন মশু, সঙ্গীত শিল্পী নজরুল ইসলাম বাচ্চু, ফতুল্লা থানা আওয়ামী লীগের যুগ্ম সম্পাদক দেলোয়ার হোসেন ভাসানী, নারায়ণগঞ্জ থানা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এবিএম নজরুল ইসলাম, স্বেচ্ছাসেবক লীগ নেতা সাইদুর রহমান সবুজ মোল্লা, মহিলা আওয়ামী লীগ নেত্রী পলি বেগম, ছাত্রলীগ কর্মী স্বপন দাস, কবি শওকত হোসেন মোক্তার, পান-সিগারেট বিক্রেতা হালিমা বেগম, সিদ্ধিরগঞ্জ ওয়ার্ড মেম্বার রাজিয়া বেগম, যুবলীগ কর্মী নিধু রাম বিশ্বাস, আব্দুস সাত্তার, আবু হানিফ, এনায়েত উল্লাহ স্বপন, আব্দুল
আলীম, শুক্কুর আলী ও স্বপন রায়। মামলা লিপিবদ্ধ ২০০১ সালের ১৬ জুন বোমা হামলার ঘটনার পর নারায়ণগঞ্জ শহর আওয়াামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এড. খোকন সাহা বাদী হয়ে পৃথক দু’টি মামলা করেন। মামলায় স্থানীয় বিএনপির ২৭ জন নেতা-কর্মীকে আসামি করা হয়। পরবর্তীতে বিএনপির শাসনামলে ২০০৩ সালের এপ্রিল মাসে মামলা দু’টির ফাইনাল রিপোর্টে বলা হয়, উল্লেখিত ২৭ জনের কেউই চাষাঢ়াস্থ আওয়ামী লীগ অফিসে ১৬ জুন ২০০১ সালের বোমা হামলায় জড়িত নয়। যদি ভবিষ্যতে অত্র মামলার তথ্য সম্বলিত ক্লু পাওয়া যায় তবে মামলাটি পুনরজ্জীবিত করার ব্যবস্থা করতে হবে। বিএনপির শাসনকালসহ দীর্ঘ প্রায় ৬ বছর মামলাটি হিমাগারে থাকার পর মহাজোট সরকার ক্ষমতায় আসার পর সিআইডির আবেদনের প্রেক্ষিতে ২০০৯ সালের ২ জুন নারায়ণগঞ্জ জেলা ও দায়রা জজ আদালত মামলাটি পুনরুজ্জীবিত করে সুষ্ঠুভাবে তদন্ত করে মামলাটি নিষ্পত্তির জন্য সরকারকে আদেশ দেয়। চাষাঢ়া বোমা হামলা মামলাটি দীর্ঘ প্রায় নয় বছর পর ২০০৯ সালের মে মাসের ১৬ তারিখে নারায়ণগঞ্জ জেলা প্রশাসনের চাঞ্চল্যকর ও লোমহর্ষক মামলা নিস্পত্তি সংক্রান্ত জেলা মনিটরিং কমিটির সভায় চাঞ্চল্যকর মামলা হিসেবে অন্তর্ভুক্ত করা হয়। মামলায় গ্রেপ্তারকৃতরা ২০০৫ সালের ১ অক্টোবর গ্রেপ্তার হয় হরকাতুল জেহাদের অন্যতম নেতা মুফতি আবদুল হান্নান। গ্রেপ্তারের পর তিনি র্যাব ও গোয়েন্দা সংস্থার নিকট দেয়া জবানবন্দিতে চাষাঢ়াস্থ আওয়ামী লীগ অফিসে বোমা হামলায় জড়িত থাকার কথা স্বীকার করেন। ২০০৬ সালের ২৬ ফেব্রুয়ারি ভারতের রাজধানী দিল্লীর একটি রেল স্টেশন হতে হরকাতুল জিহাদের ২ জঙ্গি সহোদর আনিসুল মোরসালিন ও মুহিবুল মুত্তাকিনকে গ্রেপ্তার করা হয়। তাদের বাড়ি বাংলাদেশের ফরিদপুর জেলায়। তারাও বোমা হামলা ঘটনায় জড়িত থাকার কথা স্বীকার করেছেন। দু’জনই বর্তমানে ভারতের দিল্লী কারাগারে বন্দী রয়েছেন। বোমা হামলা মামলার বারো নাম্বার আসামি শাহাদাৎ উল্লাহ জুয়েল ক্রস ফায়ারে নিহত যুবদল নেতা মমিনউল্লাহ ডেভিড ও পরিবহন নেতা মাহবুবউল্লাহ তপনের ছোট ভাই। ২০০৭ সালের ২৭ নভেম্বর শহরের মিশনপাড়ার বাসভবন থেকে জুয়েলকে গ্রেপ্তার করে র্যাব- ১১। জুয়েলের বিরুদ্ধে বঙ্গবন্ধু এভিনিউস্থ আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের সামনে প্রধানমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনার সমাবেশে গ্রেনেড হামলার অর্থ জোগান দেয়ার অভিযোগ রয়েছে। পরবর্তীতে বিগত চারদলীয় জোট সরকারের উপমন্ত্রী আবদুস সালাম পিন্টুকে চাষাঢ়া বোমা হামলা মামলায় শ্যোন অ্যারেস্ট দেখায় সিআইডি। এছাড়া গ্রেপ্তার হয়েছেন ঢাকার তৎকালীন ৫৩নং ওয়ার্ড কমিশনার ও ঢাকা মহানগর বিএনপির সাংগঠনিক সম্পাদক আরিফুর রহমান। তাদের কয়েক দফা রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করেছে সিআইডি। দিনটি স্মরণে নানা কর্মসূচি এদিকে দিনটি পালনে নারায়ণগঞ্জ চাষাঢ়াস্থ কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার প্রাঙ্গণে প্রতীকী স্তম্ভে শ্রদ্ধা নিবেদন ও মোমবাতি প্রজ্জ্বলন করার অংশহিসেবে, সকাল ৯টায় শহীদ পরিবারের পক্ষ হতে নির্মিত স্মৃতিস্তম্ভে পুস্পমাল্য অর্পণসহ দিনভর কোরআন তেলোয়াত ও দোয়া করা হয়। রাতে সামাজিক দুরত্ব বজায় রেখে সল্প পরিসরে মোমবাতী প্রজ্জ্বোলনের মধ্য দিয়ে দিনটি পালন করা হয়।
গোপনীয়তা নীতি | এই ওয়েবসাইটের কোন লেখা, ছবি, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি।