Logo
HEL [tta_listen_btn]

নারায়ণগঞ্জে হকার সমস্যার নেপথ্যে কোটি টাকার চাঁদাবাজি না রাজনীতি!

নারায়ণগঞ্জে হকার সমস্যার নেপথ্যে কোটি টাকার চাঁদাবাজি না রাজনীতি!

দেশের আলো রিপোর্ট:
নাগরিকদের চলাচলের জন্য শহরের ফুটপাতগুলো থাকবে হকারমুক্ত, এটা নারায়ণগঞ্জবাসীর প্রাণের দাবি। কিন্তু নারায়ণগঞ্জবাসীর গলার কাঁটা ফুটপাত দখলকারী এই হকাররা। চলাচলের ফুটপাতসহ সড়কের একটা অংশ হকারদের দখলে চলে যায়। প্রতিবার ঈদ কিংবা শীতকাল এলে হকারদের এই দৌরাত্ম্য আরও বেড়ে যায়। বিভিন্ন উৎসব উপলক্ষে হকারদের ফুটপাতে বসার সুযোগ দেয়ার জন্য মানবিক আবেদন জানানো হয়। মানবিক বিবেচনায় বসার সুযোগ দেয়া হলেও পরবর্তীতে হকারদের আর সরানো যায় না। হকারদের কাছে অনেকটাই জিম্মি নগরবাসী। সাধারণ মানুষের চলাচলের সুবিধার্থে শহরের ফুটপাতগুলো হকারমুক্ত করার প্রস্তাব উঠেছে বহুবার। এর আগে একাধিকবার শহর হকারমুক্ত করার জন্য বিভিন্ন উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। কিন্তু এতো কিছুর পরেও সমাধান হয়নি হকার ইস্যুর। কিছুদিন পর পর সিটি কর্পোরেশন ও পুলিশের উদ্যোগে হকারমুক্ত থাকলেও ফের দখল হয়ে যায় শহরের ফুটপাত। প্রশাসন ও জনপ্রতিনিধিদের সমন্বয়হীনতার কারণে সেসব উদ্যোগ আলোর মুখ দেখেনি। হকার সমস্যার সমাধান থেকেও রাজনৈতিক ঘুটি হিসেবে হকারদের ব্যবহার এই সমস্যাকে আরও জটিল করে তুলেছে। অভিযোগ রয়েছে ফুটপাতে হকার বসিয়ে মাসে কোটি টাকার চাঁদাবাজিও হকার সমস্যার সমাধান না হওয়ার অন্যতম কারণ। বেশ কয়েকদিন যাবৎ শহরের বঙ্গবন্ধু সড়কের ফুটপাত রয়েছে হকারমুক্ত। কিন্তু ফুটপাতে হকার বসার দাবিতে গত কয়েকদিন ধরে লাগাতার কর্মসূচি পালন করছে হকাররা। ডিসি অফিস ঘেরাও করে স্মারকলিপি দিয়েছে তারা নারায়ণগঞ্জ জেলা প্রশাসককে। হকার সমস্যা সমাধানে আইনশৃঙ্খলা কমিটির সভাতে আলাপ করবেন বলে সেইদিন আশ্বাস দেন জেলা প্রশাসক মো: জসিম উদ্দিন। পাশাপাশি হকার নেতৃবৃন্দকে সিটি মেয়র ডা. সেলিনা হায়াৎ আইভীর সাথে আলাপ করার পরামর্শ দিয়েছেন তিনি। এ সময় তিনি বলেন, মেয়র তো আপনাদের জন্য ব্যবস্থা করেছিল একবার সেই ২০০৮ সালে। কিন্তু এখন তো আপনারা পায়ে চলা ফুটপাত দখল করে ব্যবসা করতে পারেন না। ডিসির এই বক্তব্যের একদিন পরেই ঈদুল আযহাকে কেন্দ্র করে শহরের ফুটপাতে হকার বসার সুযোগ দেওয়ার জন্য সিটি মেয়র ডা. সেলিনা হায়াৎ আইভীর প্রতি অনুরোধ জানান নারায়ণগঞ্জ-৫ আসনের সাংসদ একেএম সেলিম ওসমান৷ ১০ জুলাই বিকেল সাড়ে ৫টায় শহরের সেন্ট্রাল খেয়াঘাট সংলগ্ন জেলা মুক্তিযোদ্ধা কমপ্লেক্সে অনুষ্ঠিত সদ্য প্রয়াত যুদ্ধকালীন কমান্ডার আমিনুর রহমানের স্মরণে এক দোয়া ও মিলাদ মাহফিলে তিনি এ অনুরোধ জানান। এ সময় সেলিম ওসমান বলেন, আমি মেয়রের কাছে অনুরোধ রাখবো ফুটপাতে যারা হকার আছে তাদেরকে আগামী ঈদ পর্যন্ত সুযোগ দেওয়া হোক। তবে পুলিশ প্রশাসনকে কঠোর হতে হবে। যাতে করে তারা যত্রতত্র দোকান নিয়ে না বসতে পারে সে বিষয়টা কঠোরভাবে খেয়াল রাখতে হবে। সাংসদ একেএম সেলিম ওসমানের এই আহবানের পরেই হকাররা কোন আলোচনা ছাড়াই নতুন করে ফুটপাতে বসার চেষ্টা করে কিন্তু পুলিশের কঠোর অবস্থানের কারণে তাদের সেই চেষ্টা বিফলে যায়। হকাররা এখন চাপ সৃষ্টি করতে সড়ক অবরোধের মত কঠোর কর্মসূচি নিয়েছে। জানা যায়, ফুটপাতের হকারদের পুনর্বাসনের জন্য ২০১১ সালে চাষঢ়ায় হকার্স মার্কেট করে দেন নাসিক মেয়র ডা. সেলিনা হায়াৎ আইভী। কিন্তু হকাররা তাদের জন্য বরাদ্দকৃত দোকান অন্যের কাছে বিক্রি করে দিয়ে ফের ফুটপাতে এসে বসতে শুরু করে। যার ফলে হকার্স মার্কেট থাকা সত্তে¡ও ফুটপাতে হকারের কমতি নেই। এদিকে হকার উচ্ছেদের পর যখন হকাররা পুনর্বাসনের দাবি তোলেন তখন মেয়র আইভী বঙ্গবন্ধু সড়কের বিকল্প হিসেবে হকার্স মার্কেট, হাসপাতাল রোড, জিমখানা মাঠ, ওসমানী স্টেডিয়াম এবং তার নগরভবনের সামনের সড়কে বসার প্রস্তাব দেন। এবং পুনর্বাসনের জন্য সবার সঙ্গে পরামর্শ করে সিদ্ধান্ত নিবেন বলে জানান। এমনকি হকারদের বসার জন্য ‘প্রয়োজনে হকার্স মার্কেট ভেঙ্গে দিয়ে স্টেডিয়াম করে দেবো’ বলেও ঘোষণা দেন। সদর-বন্দরের সাংসদ সেলিম ওসমানও হকারদের পুনর্বাসনের ব্যাপারে কথা বলেন। এর আগে হকার পুনর্বাসনে সাবেক জেলা প্রশাসক মো: রাব্বি মিয়া হকারদের তালিকা তৈরি করার চেষ্টা করেছেন। সেই সময় হকার নেতাদের সাথে বৈঠকে তিনি বলেছেন, জেলা প্রশাসক হিসেবে জেলার সকল নাগরিকের ব্যাপারে আমাকে বিবেচনা করতে হয়। আপনাদের (হকার) ব্যাপারে আমি যেমন ভাববো, তেমনি নারায়ণগঞ্জের আপামর জনগণের রাস্তায় চলাচলের সুবিধার কথাও বিবেচনা আমাকে করতে হবে। এ সময় হকারদের পুনর্বাসনের লক্ষ্যে তিনি ভোটার আইডি কার্ড কিংবা এলাকার কাউন্সিলরের স্বাক্ষরসহ নাগরিকত্ব সার্টিফিকেটসহ তালিকা অতিদ্রত জমা দেওয়ার নির্দেশ দেন। কিন্তু এই তালিকা আলোর মুখ দেখেনি বলে হকারদের সমস্যার স্থায়ী সমাধানও হয়নি। গত ২০১৭ সালের ২৫ ডিসেম্বর নারায়ণগঞ্জ সিটি কর্পোরেশনের মেয়র ডা. সেলিনা হায়াৎ আইভীর উদ্যোগে শহরের প্রধান সড়ক বঙ্গবন্ধু সড়কের দুই পাশের হকারদের উচ্ছেদ করা হয়। মেয়রকে সহযোগিতা করেন তৎকালীন পুলিশ সুপার মঈনুল হক। কিন্তু হকাররা ফুটপাতে বসার দাবিতে ডিসিকে স্মারকলিপি, অনশন, বিক্ষোভ মিছিল থেকে শুরু করে নানা কর্মসূচি দিতে থাকে। এই হকার ইস্যুকে কেন্দ্র করেই গত ২০১৮ সালের ১৬ জানুয়ারি মেয়র আইভী ও সাংসদ শামীম ওসমান সমর্থকদের মধ্যে রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে। এই সংঘর্ষে মেয়র আইভী, সাংবাদিকসহ অর্ধ শতাধিক আহত হয়। সংঘর্ষের পর কয়েকদিন ফুটপাত হকার মুক্ত থাকলেও ফের হকারদের দখলে চলে যায় বঙ্গবন্ধু সড়কের ফুটপাত। সচেতন মহলের মতে, পুলিশী পাহারা দিয়ে হকার উচ্ছেদ সম্ভব নয়। এসপি জনস্বার্থের কথা চিন্তা করে ফুটপাত হকারমুক্ত রেখেছেন। কিন্তু পুলিশের নানাবিধ কাজ রয়েছে। সেসব রেখে দিনের পর দিন ফুটপাত পাহারা দেওয়া সম্ভব নয়। এর জন্য জনপ্রতিনিধি ও প্রশাসনের সম্মিলিত উদ্যোগের প্রয়োজন। সিটি মেয়র ডা. সেলিনা হায়াৎ আইভী, সদর-বন্দর আসনের সাংসদ সেলিম ওসমান ও জেলা প্রশাসক জসিম উদ্দিন এক টেবিলে বসেই পারেন হকারদের পুনর্বাসন কিংবা স্থায়ী কোন সমাধানের পথ খুঁজে বের করতে। জনপ্রতিনিধি ও প্রশাসনের সমন্বয়ই কেবল পারে এই সমস্যার স্থায়ী সমাধান করতে। বিভিন্ন সূত্রে জানা গেছে, নগরীতে পেশাদার, অপেশাদার মিলিয়ে ১৫ হাজার হকার ও ভাসমান দোকানি রয়েছে। একেকজনের কাছ থেকে গড়ে ১০০ টাকা করে নেওয়া হলে মাসিক কমপক্ষে সাড়ে চার কোটি টাকার চাঁদাবাজি চলছে। ৫০ টাকা করে নেওয়া হলে মাসিক কমপক্ষে সোয়া দুই কোটি টাকার চাঁদাবাজি চলছে। অপরদিকে নারায়ণগঞ্জ ও ঢাকার বিভিন্ন রাজনৈতিক কর্মসূচিতে এই হকারদের সক্রিয় উপস্থিতি লক্ষ্য করা যায়। হকার সমস্যা জিইয়ে রেখে এই হকারদের রাজনৈতিক কাজে ব্যবহার করা হচ্ছে। এমনকি স্থানীয় রাজনীতিতে হকারদের ব্যবহার করে প্রতিপক্ষকে ঘায়েলের রাজনীতিও বিদ্যমান আছে বলে রাজনীতি বিশ্লেষকদের অভিমত। এ বিষয়ে নাগরিক কমিটির সাধারণ সম্পাদক আব্দুর রহমান বলেন, ‘হকার মার্কেটে হকার পুনর্বাসনের সময় আমরা নাসিকের সঙ্গে ছিলাম। হকারদের দোকান হস্তান্তর করার সময় হলো তখন দেখা গেল অস্বাভাবিকভাবে হকার সংখ্যা তিনগুন হয়ে গেছে। পরবর্তীতে দোকান হস্তান্তর করার কিছুদিনের মধ্যেই হকাররা তাদের দোকান বিক্রি করে আবার ফুটপাতে চলে আসে। হকারদের উচ্ছেদ করে ঠেকানো সম্ভব না মন্তব্য করে তিনি আরো বলেন, ‘হকার সমস্যার স্থায়ী সমাধান পুনর্বাসন। তবে এটা হতে হবে আইডি কার্ড ভিত্তিক আর শর্ত সাপেক্ষে। যাতে পুনর্বাসনের জন্য দেয়া দোকানগুলো তারা বিক্রি করতে না পারে এবং ভাড়াও না দিতে পারে। এছাড়া মেয়র চাইলে আরেকটি পদক্ষেপ গ্রহণ করতে পারেন। বিশ্বের অন্যান্য দেশে ছুটির দিনগুলোতে পরিচ্ছন্নতার শর্তে হকার বসার অনুমতি দেয়া হয়ে থাকে। তেমনভাবে নারায়ণগঞ্জেও করতে পারেন। তাহলে, সাধারণ মানুষ ফুটপাতে স্বাচ্ছন্দে চলাফেরা করতে পারবে এবং হকাররাও ক্ষতিগ্রস্থ হবে না।’ হকার আন্দোলনে নেতৃত্ব দেওয়া জেলা সিপিবির সভাপতি হাফিজুল ইসলাম বলেন, ‘হকাররা আমাদেরই একটি অংশ। তাদের পেটে লাথি মেরে, পুণর্বাসন ছাড়া উচ্ছেদ করা সম্পূর্ণ অযৌক্তিক। এভাবে তাদের উপর নির্যাতন করা উচিত নয়। আমি, জেলা প্রশাসক ও নারায়ণগঞ্জ সিটি কর্পোরেশন মেয়র ডা. সেলিনা হায়াত আইভীকে অনুরোধ করবো, আপনারা দুজন একসঙ্গে বসুন এবং হকাদের পুনর্বাসনের মাধ্যমে হকার সমস্যার স্থায়ী সমাধান করুন। আর যতদিন না কোনো সমাধান হচ্ছে ততোদিন রাতের বেলা কিংবা ছুটির দিনে হকারদের বসার অনুমতি দেয়া হোক।


আপনার মতামত লিখুন :

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *


Theme Created By Raytahost.Com