আড়াইহাজার সংবাদদাতা:
নারায়ণগঞ্জ জেলার আড়াইহাজার থানার এক সহকারী উপপরিদর্শক (এএসআই) মাসুম শেখ (৩৩) গ্রেফতার হয়েছেন ঢাকা গোয়েন্দা পুলিশ (ডিবি) এর হাতে। আটক পুলিশ সদস্যের নেতৃত্বে সংঘবদ্ধ অপরাধী চক্র ডাকাতিসহ নানা অপরাধমূলক কর্মকান্ড করে আসছিলেন বলে জানা যায়। অপরাধীরা সরকারি পিস্তল, হ্যান্ডকাফ, গাড়িও ব্যবহার করতেন। ডিবি পরিচয়ে ডাকাতির মাধ্যমে সাড়ে ৯ লাখ টাকা হাতিয়ে নেওয়ার অভিযোগে সম্প্রতি ওই পুলিশ সদস্যকে গ্রেফতার করেছে। গ্রেফতারকৃত মাসুম শেখের গ্রামের বাড়ি গোপালগঞ্জের মুকসুদপুরে। যদিও ডাকাতির কথা অস্বীকার করে আড়াইহাজার থানা পুলিশের পরিদর্শক (তদন্ত) শওকত হোসেন বলেন, মাসুম শেখ সপ্তাহ খানিক আগে থেকে ছুটিতে রয়েছে। অন্যদিকে ঘটনার সত্যতা নিশ্চিত করেছেন ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ(ডিবি)এর বিভাগীয় কর্মকর্তা (লালবাগ) সহকারী পুলিশ কমিশনার (এসি) মোঃ ফজলুর রহমান। এসি মোঃ ফজলুর রহমান বলেন, মাসুম শেখকে একটি প্রাইভেটকারসহ মিরপুর থেকে ১৪ ডিসেম্বর গ্রেফতার করি। এরা সংঘবদ্ধ অপরাধী চক্র। গত ৩ ডিসেম্বর চক্রটির বেশ কিছু সদস্যদের আমরা গ্রেফতার করেছিলাম। তাদের দেয়া তথ্য অনুযায়ী পরবর্তিতে মাসুম শেখকে গ্রেফতার করা হয়। অপর এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, বর্তমানে আইনগত প্রক্রিয়ায় মামলাটি চলছে ঢাকার একটি আদালতে। আদালতের নির্দেশে কোন জেলখানায় মাসুম রয়েছে, তা সঠিক জানা নেই; সম্ভবত কেরানিগঞ্জ কারাগারে বন্দি আছে। অভিযোগ সূত্রে জানা যায়, কখনো রিকশাচালক, কখনো ফেরিওয়ালা সেজে ওই চক্রের সদস্যরা সাধারণ মানুষের কাছে সাহায্য চায়। তারা বলে, তাদের কাছে বেশকিছু বিদেশি রিয়েল (মুদ্রা) আছে। তারা অশিক্ষিত। কীভাবে মুদ্রাগুলো ভাঙাতে হয় তা জানেন না। কিছু টাকার বিনিময়ে যদি ভাঙিয়ে দেন তাহলে খুব উপকার হবে বলে প্রস্তাব দেয়। পরবর্তীতে ফোনে আবারও যোগাযোগ করে জানায় যে, তার কাছে আরও অনেক রিয়েল আছে। এভাবে লোভ দেখিয়ে পছন্দমতো জায়গায় নির্দিষ্ট তারিখ ও সময়ে আসতে বলে। একই চক্রের আরেকটি দল ডিবি পুলিশ সেজে ওই তারিখ ও সময়ে নির্ধারিত স্থানে পিস্তল, ওয়ারলেস সেট, হ্যান্ডকাফসহ মাইক্রোবাসে অপেক্ষা করতে থাকে। এদিকে রিকশাচালক কিংবা ফেরিওয়ালাবেশে থাকা প্রতারক কাপড়ে মুড়ে রিয়েলের নামে কাগজ বা অন্য কোনো জিনিস নিয়ে এসে রিয়েল ক্রেতা ভুক্তভোগীকে দেয়। এরপর টাকা হাতে নিয়ে বলে, পুলিশ আসছে তাড়াতাড়ি চলে যান। এ কথা বলে ফেরিওয়ালাবেশে থাকা প্রতারক টাকা নিয়ে সটকে পড়ে। এসি মোঃ ফজলুর রহমানের তথ্য মতে, চক্রটির প্রতারণার শিকার ভুক্তভোগীদের অভিযোগের প্রেক্ষিতে দীর্ঘদিন তদন্ত ও অনুসন্ধান চালাতে থাকেন। প্রযুক্তির সহযোগীতায় গত ৩ ডিসেম্বর বিকালে রাজধানীর যাত্রাবাড়ী থেকে চক্রটির ১০ সদস্যকে গ্রেফতার করা হয়। তারা হলেন মহসিন শেখ, আনিছুর রহমান, সেন্টু মুন্সি, জুয়েল মিয়া, শাহিন শেখ, মহব্বত শেখ, আবুল কালাম, সুলতান মোল্লা, হেমায়েত শেখ ও কাইয়ুম শেখ। পরবর্তীতে এদের তথ্যের সূত্র ধরে ১৪ ডিসেম্বর চক্রটির মূলহোতা আড়াইহাজার থানার এএসআই মাসুম শেখকে গ্রেফতার করা হয়। এসি মোঃ ফজলুর রহমান আরও বলেন, এএসআই মাসুম শেখ দীর্ঘদিন ধরে ডিবি পুলিশ পরিচয়ে ডাকাতি, ছিনতাইসহ নানা অপরাধমূলক কর্মকান্ড করে আসছিলেন। তারা সবাই এবই গ্রামের। গোপালগঞ্জের মুকসুদপুরের একে অপরের পরিচিত, আতœীয়। সংঘবদ্ধ এ অপরাধীচক্রটি ঢাকা ও আশপাশের এলাকায় তাদের কর্মকান্ড চালাতো। ডিবি পুলিশ পরিচয় দিয়ে অপরাধ করে আসছিল। অপরাধমূলক কর্মকান্ডে জড়িত থাকার প্রমাণপত্র হাতে পাওয়ার পর মাসুমকে গ্রেফতার করা হয়েছে। জব্দ করা হয়েছে ডাকাতির কাজে ব্যবহার করা পিস্তল, হ্যান্ডকাফ ও একটি প্রাইভেট কার। ডিবি পুলিশের পরিচয়ে এই অপরাধী চক্রের সদস্যরা এমনভাবে ডাকাতি করত যে ভুক্তভোগীদের বোঝার উপায় থাকত না, তাঁরা আসলে ভুয়া ডিবি। কারণ, পি¯ø, হ্যান্ডকাফ সবই পুলিশের। মামলার নথিপত্রের তথ্য বলছে, আবদুল আওয়াল নামের এক ব্যক্তি রামপুরার একটি মাদ্রাসায় শিক্ষকতা করেন। গত ৮ সেপ্টেম্বর তিনি রামপুরার টিভি সেন্টারের সামনে দাঁড়িয়ে ছিলেন। তখন কথিত বাবু নামের এক ব্যক্তি মাদ্রাসাশিক্ষক আওয়ালের কাছে এসে বলেন, পেশায় তিনি রিকশাচালক। তিনি লেখাপড়া জানেন না। ১০০ রিয়াল ভাঙানোর জন্য তিনি সাহায্য চান। কথোপকথনের একপর্যায়ে আওয়াল ওই ব্যক্তির কাছে জানতে চান, রিয়াল কোথায় পেয়েছেন? জবাবে বাবু জানান, তাঁর পরিচিত একজন পরিচ্ছন্নতাকর্মী ওই রিয়াল রাস্তায় কুড়িয়ে পেয়েছেন। কথিত রিকশাচালক বাবুর কথায় বিশ্বাস করে রিয়াল ভাঙিয়ে দেন আওয়াল। পরে কথিত পরিচ্ছন্নতাকর্মী হায়দারকে আওয়ালের কাছে হাজির করেন বাবু। মোট ১ হাজার ৮৬০ রিয়াল ভাঙানোর জন্য মাদ্রাসাশিক্ষক আওয়ালকে অনুরোধ করেন কথিত পরিচ্ছন্নতাকর্মী হায়দার। রিয়ালগুলো ভাঙিয়ে দিলে অর্ধেক টাকা আওয়ালকে দেওয়ার প্রস্তাব দেন বাবু ও হায়দার। তাঁদের রিয়ালগুলো বুঝিয়ে নেওয়ার জন্য আওয়ালকে রামপুরার লেহাজ হোটেলের সামনে আসতে বলেন বাবু ও হায়দার। প্রলোভনে পড়া মাদ্রাসাশিক্ষক আওয়াল রিয়ালগুলো নেওয়ার জন্য নিজের ব্যাংক হিসাব থেকে পাঁচ লাখ টাকা তুলে আসেন লোহাজ হোটেলের সামনে। আওয়াল পাঁচ লাখ টাকা বাবু ও হায়দারকে বুঝিয়ে দেন। তখন বাবু ও হায়দার আওয়ালের হাতে প্যাকেটভর্তি কথিত রিয়াল তুলে দেন। তখন সেখানে একটি প্রাইভেট কার এসে থামে। প্রাইভেট কার থেকে নেমে তিনজন ব্যক্তি আওয়ালের কাছে আসেন এবং নিজেদের ডিবি পুলিশের পরিচয় দেন। আওয়ালকে জোর করে প্রাইভেট কারে তুলে হ্যান্ডকাফ পরান কথিত ডিবি পুলিশের সদস্যরা। রিয়ালগুলো কার কাছ থেকে সংগ্রহ করেছেন, কাগজপত্র কোথায় ইত্যাদি নানা কথা জানতে চায় ডিবি পরিচয় দেওয়া তিন ব্যক্তি। আওয়ালকে মামলা দিয়ে জেলে পাঠানোর কথা জানান তাঁরা। আওয়ালকে অবৈধ ব্যবসায়ী হিসেবে গণমাধ্যমের সামনে তুলে ধরার হুমকি দেওয়া হয়। তবে ১০ লাখ টাকা দিলে তাঁকে ছেড়ে দেওয়া হবে বলেও জানানো হয়। তাঁর ব্যাংক হিসাবে যত টাকা আছে, তা দেবেন বলে জানান আওয়াল। আওয়ালের ব্যাংক হিসাব থেকে আরও সাড়ে তিন লাখ টাকা তুলে নেয় কথিত ডিবি পুলিশের দল। ঢাকা মহানগর ডিবির লালবাগ বিভাগের তদন্তে উঠে আসে, মাদ্রাসাশিক্ষক আওয়ালের কাছে প্রথমে যিনি রিকশাচালকের পরিচয় দিয়ে রিয়াল ভাঙানোর ফাঁদ পেতেছিলেন, আসলে তিনি সংঘবদ্ধ অপরাধী চক্রের সদস্য। তাঁর প্রকৃত নাম আনিছুর রহমান। আর হায়দার পরিচয় দেওয়া কথিত পরিচ্ছনতাকর্মী হলেন প্রতারক চক্রের আরেক সদস্য শওকত। ডিবি পুলিশের পরিচয় দিয়ে আওয়ালের কাছ থেকে যাঁরা টাকা হাতিয়ে নিয়েছিলেন, তাঁরা ডিবি সদস্য নন। প্রকৃতপক্ষে পুলিশ সদস্য মাসুম শেখ আওয়ালের কাছ থেকে টাকা হাতিয়ে নেন। আড়াইহাজার থানা পুলিশ একটি সূত্র জানিয়েছে, উচিৎপুরা ইউপিতে বিট নং-১০ দায়িত্ব পালন করতেন এএসআই মাসুম শেখ।
গোপনীয়তা নীতি | এই ওয়েবসাইটের কোন লেখা, ছবি, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি।