নিজস্ব সংবাদদাতা :
রোববার (২৮ মার্চ) হেফাজতের ডাকা সকাল-সন্ধ্যা হরতাল নগরীতে ঢিলেঢালা ভাবে পালিত হলেও স¦াভাবিক জীবনযাত্রা ব্যাহত হয়ে পড়েছিলো। তবে শহরের বাইরে বিভিন্ন স্থানে পিকেটারদের তৎপরতা ছিলো মারমুখি। ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের নারায়ণগঞ্জ অংশে অন্তত ১০টি জায়গায় প্রতিবন্ধকতা তৈরি করেছেন হেফাজতের নেতা-কর্মীরা। এ সময় প্রায় ৬ থেকে ৭টি পরিবহনে অগ্নিসংযোগ করা হয়েছে। ২ জন গুলিবিদ্ধ সহ আহত আছে প্রায় অর্ধশতাধিক। বাংলাদেশের স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীর অনুষ্ঠানে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির অংশগ্রহণ বাতিলের দাবিতে হেফাজতে ইসলামের বিক্ষোভে অংশ নিয়ে গত ২ দিনে সারাদেশে ১০ জন নিহত হন। এর প্রতিবাদে হেফাজতের আমির মাওলানা জুনায়েদ বাবুনগরী শুক্রবারে ঘোষণা দেন ‘রোববার সকাল সন্ধ্যা হরতাল’। হরতালের সমর্থনে রোববার ফজরের পর থেকেই হেফাজতের কছেশ শ’ নেতা-কর্মী ও মাদ্রাসাশিক্ষার্থী মহাসড়কে অবস্থান নিয়ে সব ধরণের যান চলাচল বন্ধ করে দেন। প্রথম দিকে টায়ার, গাছের গুঁড়ি ও বাঁশে আগুন জ্বালিয়ে বিক্ষোভ প্রদর্শন করতে থাকেন। এ ছাড়া বিভিন্ন পয়েন্টে লাঠিসোঁটা নিয়ে অবস্থান নিতে দেখা যায় তাদের। বেলা বাড়ার সঙ্গে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে মহাসড়কে সাঁজোয়া যান নিয়ে অবস্থান নেয় পুলিশ। হেফাজতের নেতা-কর্মী ও মাদ্রাসাশিক্ষার্থী ছাড়াও সেখানে সকাল থেকেই প্রচুরসংখ্যক ‘বহিরাগত’ অবস্থান করছে বলে জানিয়েছেন স্থানীয়রা। পুলিশ কয়েক দফা হরতাল সমর্থকদের বুঝিয়ে মহাসড়ক থেকে সরিয়ে দেয়ার চেষ্টা করলেও ফল হয়নি। অনেক জায়গায় পুলিশকে উদ্যোগী হয়ে টায়ারের আগুন নেভাতে দেখা যায়। তবে এর কিছুক্ষণ পর আবারো অশান্ত হয়ে ওঠে পুরো এলাকা। এক পর্যায়ে সড়কের যানবাহন ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগ করে বিক্ষোভকারীরা। এ সময় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সঙ্গে তাদের দফায় দফায় সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে। পিকেটাররা তিনটি ট্রাক, একটি বাস ও একটি মাইক্রোবাসে আগুন দেয়। এরপর সারাদিনই সড়কের যানচলাচল বন্ধ ছিল। সন্ধ্যার কিছু পূর্বে যখন পরিস্থিতি স্বাভাবিক হচ্ছিল, ঠিক তখনই এক দল পিকেটার এসে শিমরাইল এলাকায় একটি যাত্রীবাহী বাসে আগুন দিয়ে পুড়িয়ে দিয়েছে। এ সময়ও পুলিশ ও হেফাজত নেতাকর্মীর মধ্যে আবারও ধাওয়া পাল্টা ধাওয়া হয়। ব্যস্ত এই মহাসড়কে যান চলাচল বন্ধ থাকায় সারাদিনই হাজার হাজার মানুষ হেঁটে যেতে বাধ্য হন। হরতালকে কেন্দ্র করে সাইনবোর্ড, শিমরাইলসহ বিভিন্ন এলাকায় নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটের নেতৃত্বে বিপুলসংখ্যক পুলিশ বিজিবি ও র্যাব সদস্য মোতায়েন ছিল। হেফাজত ইসলামের ডাকে সকাল-সন্ধ্যা হরতালে নারায়ণগঞ্জ শহরের মধ্যে যান চলাচল স্বাভাবিক রয়েছে। তবে, ব্যক্তিগত যানবাহনের সংখ্যা অন্যান্য দিনের তুলনায় কম চলাচল করতে দেখা গেছে সকাল ৬টা থেকে যান চলাচল কিছুটা কম থাকলেও বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে সড়কে যান চলাচল বাড়তে থাকে। তবে, অন্যান্য দিনের তুলনায় যাত্রী সংখ্যা কিছুটা কম দেখা গেছে। এদিকে নাশকতা ঠেকাতে প্রতিটি মোড়ে মোড়ে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীকে অবস্থান নিতে দেখা গেছে। তবে, এসব এলাকায় সকালে কিছুটা হরতাল সমর্থনকারীদের দেখা গেলেও দিনের বাকি সময়ে দেখা যায়নি। অন্যদিকে, সকাল থেকে হরতাল প্রতিরোধে আওয়ামী লীগের বিভিন্ন সংগঠন মিছিল বের করেছেন। হেফাজতে ইসলামের হরতাল ঘিরে সকাল থেকেই নারায়ণগঞ্জ শহরসহ পুরো জেলায় কঠোর নিরাপত্তামূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছে। সতর্ক অবস্থানে রয়েছে বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ (বিজিবি), পুলিশ ও র্যাব। এ ছাড়া সাদা পোশাকে গোয়েন্দা সংস্থার সদস্যরা তৎপর রয়েছেন। হরতালকে কেন্দ্র করে শহরের ডিআইটি, চাষাঢ়া, সাইনবোর্ড, শিমরাইলসহ বিভিন্ন এলাকায় নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটের নেতৃত্বে বিপুলসংখ্যক পুলিশ মোতায়েন রয়েছে। মোতায়েন রয়েছে বিজিবি ও র্যাব। হরতালের সময় না বাড়িয়ে নতুন কর্মসূচি ঘোষণা করেছে হেফাজতে ইসলাম বাংলাদেশ। সোমবার দেশব্যাপী দোয়া মাহফিল ও আগামী শুক্রবার বিক্ষোভ মিছিল করবে সংগঠনটি। বিকালে রাজধানীর পল্টনে হেফাজতের ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব মাওলানা নুরুল ইসলাম জিহাদী এ কর্মসূচি ঘোষণা করেন। তিনি বলেন, হেফাজতে ইসলাম মোদির আগমন প্রত্যাহার করার জন্য কর্মসূচি দিয়েছিল। মোদির আগমনের দিন হেফাজতের কোনো কর্মসূচি ছিল না। কিন্তু ওইদিন সাধারণ মানুষের আন্দোলনে প্রশাসন গুলি চালিয়েছে। যার প্রতিবাদে এ হরতাল আহ্বান করা হয়েছিল।
সংবাদকর্মীদের মারধর
সংবাদকর্মীদের দেখলেই মারমুখী ও হিংস্র হয়ে উঠছে ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কে অবস্থান নেয়া হেফাজতের পিকেটাররা। রোববার (২৮ মার্চ) হরতালে দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে শিমরাইল-সাইনবোর্ড এলাকায় অন্তত সাতজন সংবাদকর্মী মারধরের শিকার হয়েছেন। চুর্ণবিচূর্ণ করে দেয়া হয়েছে একটি বেসরকারি টেলিভিশনের গাড়ি। মোদি বিরোধী বিক্ষোভের অংশ হিসেবে রোববার সারাদেশে সকাল সন্ধ্যা হরতাল পালন করছে হেফাজতে ইসলাম বাংলাদেশ। সকাল থেকে নারায়ণগঞ্জ শহরসহ উপজেলা শহরগুলো কর্মমুখর ও স্বাভাবিক থাকলেও ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের শিমরাইল থেকে সাইনবোর্ড পর্যন্ত এলাকায় তান্ডব চালিয়েছে হেফাজতের কর্মী-সমর্থকরা। সড়কটিতে যান চলাচল বন্ধ রাখতে সকাল থেকেই বাঁশ, কাঠ ও টায়ার জ্বালিয়ে অবস্থান নেয় পিকেটাররা। হরতাল না মেনে গাড়ি চলাচল করায় বেশকিছু যানবাহন ভাঙচুর ও ট্রাকে আগুন ধরিয়ে দেয়া হয়। এ সময় পুলিশ পিকেটারদের সরিয়ে দেয়ার চেষ্টা করলে সংঘর্ষের সৃষ্টি হয়। দফায় দফায় সংঘর্ষে বিকেল তিনটা পর্যন্ত পুলিশ পিকেটার ও সাধারণ পথচারীসহ অন্তত ৩০ জন আহত হয় বলে পুলিশের সূত্রগুলো জানিয়েছে। এসব ঘটনার সংবাদ সংগ্রহ করতে সকাল থেকেই মাঠে ছিলেন ঢাকা ও নারায়ণগঞ্জের বিভিন্ন গণমাধ্যমের সংবাদকর্মীরা। এ সময় সংবাদ সংগ্রহ ও ছবি তুলতে গেলে দৈনিক সংবাদ, ইন্ডিপেন্ডেন্ট টেলিভিশন, নয়াদিগন্ত ও চ্যানেল টোয়েন্টিফোরসহ বিভিন্ন গণমাধ্যমের অন্তত সাতজন সংবাদকর্মীকে মারধর, গাড়ি ভাঙচুর ও মুঠোফোন কেড়ে নেয় পিকেটাররা। সকালে শিমরাইল মোড়ে ছবি তুলতে গেলে পিকেটারদের মারধরের শিকার হন নয়াদিগন্তের নারায়ণগঞ্জে কর্মরত এক সংবাদকর্মী। নাম না প্রকাশের শর্তে তিনি বলেন, পিকেটাররা সড়ক অবরোধ করে আগুন ধরাচ্ছিলো, সে ঘটনার ছবি তুলতে গেলে তারা মোবাইল কেড়ে নিয়ে মারধর করে। সাংবাদিক পরিচয় দেয়ার পর তারা আরো বেশি মারমুখী হয়ে উঠে। একই স্থানে সংবাদ সংগ্রহ করতে গিয়ে দুপুরে মারধরের শিকার হন দৈনিক সংবাদের নারায়ণগঞ্জ জেলা প্রতিনিধি ও প্রেস নারায়ণগঞ্জের চীফ রিপোর্টার সৌরভ হোসেন সিয়াম। ঘটনার বর্ণনা দিতে গিয়ে সিয়াম বলেন, সিদ্ধিরগঞ্জের মাদানীনগর মাদরাসার সামনে কয়েকটি বাস ও ট্রাকে আগুন ধরিয়ে দেয় হেফাজতের কর্মী-সমর্থকরা। ভাঙচুর চালায় আরও কিছু গাড়িতে। দুপুর দুইটার দিকে পোড়ানো বাসের ছবি তুলতে গেলে ফুটওভার ব্রিজের নিচে সিয়ামকে মারধর করে হেফাজতের কর্মী-সমর্থকরা। কোনোমতে দৌড়ে পালানোর চেষ্টা করলে তাকে একটি গাছ কাটা করাতকলের ভেতর অবরুদ্ধ করে তারা। তার মোবাইল-পরিচয়পত্র ছিনিয়ে নেয়। সাংবাদিকদের উদ্দেশ্যে অশ্লীল ভাষায় গালিগালাজ করেন হরতাল সমর্থকরা। মোবাইলে ধারণ করা ছবি-ভিডিও সব মুছে (ডিলিট) ফেলে। হিন্দু কিনা, চার কালেমা জানেন কিনা এসব প্রশ্ন করে হেফাজতের কর্মীরা। প্রায় বিশ মিনিট অবরুদ্ধ থাকার পর ছাড়া পান সিয়াম। তার হাত, পা, মুখ ও তলপেটে আঘাতপ্রাপ্ত হন তিনি।
এ ঘটনার পর দুপুরে সাইনবোর্ড মোড়ে পিকেটারদের হিংস্রতার শিকার হন চ্যানেল টোয়েন্টিফোরের মৌ খন্দকারসহ তার দুই সহকর্মী। এ সময় পিকেটাররা চ্যানেলটির গাড়ি ভাঙচুর ও চালককে মারধর করে। ইন্ডিপেন্ডেন্ট টেলিভিশনের রায়হান কবিরও মারধরের শিকার হন। দুপুর আড়াইটার দিকে সিদ্ধিরগঞ্জের সাইনবোর্ড এলাকায় প্রো-অ্যাক্টিভ হাসপাতালের সামনে নিউজ টোয়েন্টিফোর নামে বেসরকারি টেলিভিশনের গাড়ি আটকে ভাঙচুর চালানো হয়। গাড়িতে থাকা নারী সংবাদকর্মী ও চালক হেফাজতের রোষানলের মুখে পড়েন। গাড়ি ফেরত আনতে সাংবাদিকরা এগিয়ে গেলে তাদের উদ্দেশ্যেও ঢিল ছুড়তে থাকে পিকেটাররা। কয়েকবার ব্যর্থ চেষ্টার পর পুলিশ-বিজিবির সহায়তায় বিধ্বস্ত গাড়িটি উদ্ধার করা সম্ভব হয়।
গোপনীয়তা নীতি | এই ওয়েবসাইটের কোন লেখা, ছবি, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি।