নিজস্ব সংবাদদাতা
সৌন্দর্য বর্ধনের নামে একদিকে যেমন ঐতিহ্য হারাচ্ছে বাবুরাইল খাল, অন্যদিকে হারিয়েছে খালটির প্রবাহ। মেয়র আইভী লেক শব্দ ব্যবহার করে বাবুরাইল খালকে ড্রেন বানিয়ে ফেলেছেন। শীতলক্ষ্যা ও ধলেশ্বরী নদীর তিন কিলোমিটারের সংযোগ ‘বাবুরাইল খাল’ নিয়ে ২০১৭ সালের ৩১ জানুয়ারি কথা গুলো বলেছিলেন নারায়ণগঞ্জ সিটি কর্পোরেশনের মেয়র সেলিনা হায়াৎ আইভী। এরপর দীর্ঘ ৫ বছর চলে গেছে। খালের বিভিন্ন অংশের কাজও হয়েছে। এখনও চলমান রয়েছে বিশাল অংশের কাজ। তারপরেও তড়িঘড়ি করে যখন উদ্বোধনের অপেক্ষায় (পাঁয়তারা) মেয়র সেলিনা হায়াৎ আইভী। ঠিক তখনই দু’নদীর সংযুক্ত এই খালটিতে গিয়ে দেখা গেছে, খাল উদ্ধারে উচ্ছেদ ও খননকাজ শেষ হলেও নদীর সাথে সংযোগ আর নেই। স্থানীয়রা বলছেন, সৌন্দর্য্য বর্ধনের নামে একদিকে যেমন ঐতিহ্য হারাচ্ছে বাবুরাইল খাল, অন্যদিকে হারিয়েছে খালটির প্রবাহ। লেক শব্দ ব্যবহার করে ড্রেন বানিয়ে ফেলেছে। স্থানীয় সূত্রে জানা যায়, আশির দশকেও শীতলক্ষ্যা ও ধলেশ্বরী নদীর সঙ্গে সংযোগ ছিল তিন কিলোমিটারের বাবুরাইল খালের। এ খাল হয়ে শীতলক্ষ্যা ও ধলেশ্বরী নদীতে বিভিন্ন অঞ্চল থেকে পাটসহ নানা পণ্যবাহী নৌকা চলাচল করত। তখন এ খালের পানিও ছিল স্বচ্ছ। এলাকার লোকজন গোসলসহ নানা কাজে খালের পানি ব্যবহার করত। নব্বইয়ের দশকের পর থেকে খালটি আস্তে আস্তে দখল ও ভরাট হতে থাকে। এরপর খালে আর নৌকা চলাচল করেনি। ভরাটের কারণে খালটির অস্তিত্ব হুমকির মুখে পড়ে। ২০১৮ সালে বিশ্ব ব্যাংকের অর্থায়নে ১৯৪ কোটি টাকা ব্যয়ে চারটি প্রকল্পের আওতায় বাবুরাইল খাল খনন, দুই পার সংস্কার করে ওয়াকওয়ে নির্মাণ এবং দৃষ্টিনন্দন লেক করার প্রকল্প হাতে নেয় নারায়ণগঞ্জ সিটি কর্পোরেশন। কাজ গুলোর ঠিকাদার প্রতিষ্ঠান ছিল মেসার্স রতœা এন্টারপ্রাইজ, মেসার্স মুনিয়া ট্রেডার্স, বেনজির কনস্ট্রাকশন এন্ড দি আজাদ ইঞ্জিনিয়ার্স জেভি এবং মেসার্স ইউনুস আল মামুন। চলতি বছরের ৩০ মে প্রকল্প শেষ হওয়ার তারিখ ছিল। ঠিকাদার প্রতিষ্ঠান গুলো মেয়র আইভীর ঘনিষ্ঠজনদের বলে অভিযোগ রয়েছে। সরেজমিনে ১৩ নভেম্বর থেকে ১৬ নভেম্বর প্রকল্পটির বিভিন্ন দিক পর্যবেক্ষণ করে দেখা যায়, এখনও বিভিন্ন স্থানে বা অংশে কাজ চলমান রয়েছে। বাবুরাইল খালের শীতলক্ষ্যার সংযোগ স্থানে রাস্তা দিয়ে ও বøক ফেলে পানি আটকে রাখা হয়েছে, এতে শীতলক্ষ্যা নদী থেকে পণ্যবাহী নৌকাই নয়, অন্য কোন নৌকায়ই চলাচল করতে পারছে না বা পারবেও না। একই ভাবে কোন ধরণের প্রবাহও নেই খালটিতে। খালের মন্ডলপাড়া ব্রিজের কাজ এখনও শেষ হয়নি। এছাড়াও খালের পাশে সড়কে রেলিং না দেয়ায় বাবুরাইল থেকে কাশিপুর পর্যন্ত বিভিন্ন অংশে রাতের আধাঁরে পথচারীরা খালে পড়ে আহত হওয়ার কথা জানিয়েছেন। বাংলাদেশ পানি আইন, ২০১৩ তে ‘খাল’ অর্থ পানির অন্তঃপ্রবাহ বা বহিঃপ্রবাহের পথ। ২০ ধারা অনুযায়ী, ‘কোন ব্যক্তি বা সংস্থা, কোন জলাধারে, তীরবর্তী হউক বা না হউক, স্থাপনা নির্মাণ করে বা জলাধার ভরাট করে বা জলাধার থেকে মাটি বা বালু উত্তোলন করে জলস্রোতের স্বাভাবিক প্রবাহ বন্ধ বা প্রবাহে বাধা সৃষ্টি বা গতিপথ পরিবর্তন বা পরিবর্তনের চেষ্টা করিতে পারিবে না। এ ব্যাপারে নারায়ণগঞ্জ সিটি কর্পোরেশনের পরিকল্পনাবিদ মো. মঈনুল ইসলাম বলেন, বাবুরাইল খালের প্রশস্ত ও গভীরতা আরও বেশি ছিল। তাই অতিতে মানুষ পণ্যবাহী নৌকা নিয়ে চলাচল করতে পেরেছে। এখন উন্নয়ন কাজ হচ্ছে, তবে আগের গভীরতা নেই। তাছাড়া বাংলাবাজারের পরের অংশে খালটি সিটি কর্পোরেশনের নয়। তাই ধলেশ্বরী নদীর সাথে সংযুক্ত করা যায়নি। শীতলক্ষ্যা নদীর অংশের কাজ সম্পন্ন হলেও নদীর পানি নষ্ট হওয়ায় খালের মুখে বাঁধ দিয়ে রাখা হয়েছে। যেহেতু খালে পানি প্রবাহের একটি বিষয় রয়েছে, তাই শীতলক্ষ্যার পানি পরিস্কার হলে বাঁধটি খুলে দেওয়া হবে। কাশীপুর বাংলা বাজারের বাসিন্দা আব্দুল ওয়াব জানান, সড়ক পথে পণ্য পরিবহন ব্যয় বেশি হওয়ায় আগে মানুষ নদী পথেই পণ্য আনা নেওয়া করতেন। এই খালটি ব্যবহার করে দেওভোগ, বাবুরাইলের মতোই কাশিপুর, আলীরটেক ও বক্তাবলী ইউনিয়নের মানুষ নৌপথে পণ্য আনা নেওয়া করতেন। এখন এই খালে নদী থেকে প্রবেশ পথ বন্ধ করে দেওয়ায় নৌপথে চলাচলের ব্যবস্থাও বন্ধ হয়ে গেছে। তবে, নারায়ণঞ্জের পরিবেশকর্মী সুজিত সরকার বলছেন, উন্নয়নের নামে খালটির শীতলক্ষ্যা ও ধলেশ্বরী নদীর সঙ্গে সংযোগ বন্ধ করে খালের প্রবাহ-ই নষ্ট করেনি, বরং পুরো খালকেই মেরে ফেলা হয়েছে। এছাড়া নদী থেকে বাবুরাইল খালের গভীরতা কম করায় খালে নৌকা চলার সুযোগ আর নেই। এখন বাবুরাইল খালের পানির প্রবাহ বা সক্রিয়তা বলতে কিছুই নেই। এতে জীব বৈচিত্র হুমকির মুখে পড়ছে। উন্নয়নের নামে খালের প্রবাহ বন্ধ করা দূরদর্শিতার অভাব। খালটিকে একটি আধুনিক ড্রেনে রূপান্তর করা হয়েছে। এ ব্যাপারে আমরা নারায়ণগঞ্জবাসীর সভাপতি মন্ডলীর সদস্য এড. মাহবুবুর রহমান ঈসমাইল বলেন, জনস্বার্থের নামে একটি সিদ্ধান্ত নিয়ে পরবর্তী পর্যায়ে অনেকে সেই সিদ্ধান্তে না থেকে নতুন প্রকল্প ও নতুন বাজেটে বেশি গুরুত্ব দেয়। এতে দ্বিগুন, তিন গুন অর্থ ব্যয় হয় ঠিকই, কিন্তু জনগণের কাজে আসে না। বাবুরাইল খালের ক্ষেত্রেও একই অবস্থা হয়েছে। অর্থ ব্যয় যে পরিমান হয়েছে, জনস্বার্থ সে পরিমান আসেনি। আমার মতে, এটি অর্থ বরাদ্দের জন্য লোক দেখানো প্রকল্প, আর কিছুই না।
গোপনীয়তা নীতি | এই ওয়েবসাইটের কোন লেখা, ছবি, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি।