দেশের আলো রিপোর্ট
দেশের অর্থনীতির অন্যতম চালিকাশক্তি পোশাক শিল্প। তৈরি পোশাক রপ্তানিতে চীনের পরই বাংলাদেশের অবস্থান। পৃথিবীতে মেইড ইন বাংলাদেশ খ্যাতি দিয়েছে এ পণ্য। নারায়ণগঞ্জের শিল্পাঞ্চল থেকে এর বিশাল একটি অংশের জোগান হয়। কিন্তু করোনা মহামারি, রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ ও গ্যাস সংকট এবং সর্বশেষ লোডশেডিংয়ে পণ্য উৎপাদন হুমকিতে পড়েছে। এ পরিস্থিতি চলমান থাকলে পথে বসতে হবে বলে জানিয়েছেন কারখানার মালিকরা। খোঁজ নিয়ে জানা যায়, দীর্ঘ সময় ধরে নারায়ণগঞ্জে গ্যাস সমস্যা রয়েছে। গ্যাসের চাপ না থাকায় উৎপাদন ব্যাহত হচ্ছে। বিকল্প বিদ্যুৎ ব্যবহার করে চলছে উৎপাদন কাজ। কিন্তু লোডশেডিংয়ের কারণে এ পদ্ধতিতেও কাজ ব্যাহত হচ্ছে। এতে কমে যাচ্ছে কারখানার অর্ডার। চাকরি হারাচ্ছেন অনেকে। শিল্প সংশ্লিষ্টরা বলছেন, গ্যাস-বিদ্যুতের সংকট দীর্ঘায়িত হলে রপ্তানি খাতে চাপ বাড়বে। বাড়বে উৎপাদন ব্যয়। এছাড়া ক্রেতাদের কাছে সময় মতো পণ্য পৌঁছাতে না পারলে প্রতিযোগিতা থেকে ছিটকে পড়তে হবে। এরই মধ্যে রপ্তানি আদেশ কমতে শুরু করেছে। বিসিক এলাকার একটি নিটিং কারখানার ম্যানেজার পদে কর্মরত রয়েছেন রিপন সাহা। তিনি বলেন, কারখানায় অর্ডার কমেছে। কারখানায় তেমন কাজ নেই। মালিক ভর্তুকি দিয়ে কারখানা চালাচ্ছেন। এখন যে অবস্থা চলছে করোনার সময়ও এমন ছিল না। এভাবে চলতে থাকলে ভবিষ্যতে কি হবে জানি না।
এইচ এম অ্যাপারেলসের মার্চেন্ডাইজার রাজীব সরকারবলেন, ঠিকমতো বেতন না পাওয়ায় চাকরি ছাড়তে বাধ্য হয়েছেন।যখন যোগ দেই তখনও বুঝতে পারিনি কারখানায় কাজ নেই। যোগ দেওয়ার পর বুঝলাম কাজ কম। বেতনও ঠিকমতো পেতাম না। তাই চাকরি ছেড়েছি। এখন বেকার। নতুন কোথাও যোগ দেওয়ার চেষ্টা করছি। বিক্রমপুর হোসিয়ারির ম্যানেজার নুরুল ইসলাম বলেন, বিভিন্ন ধরনের সমস্যা মোকাবিলা করতে হচ্ছে। লোডশেডিংয়ের কারণে উৎপাদন কম হলে লেবার খরচ ঠিকই হচ্ছে। উৎপাদন কম হওয়ায় ঘাটতি থাকছে। অনেক জায়গায় জেনারেটর না থাকায় প্রোডাকশনে ক্ষতি হচ্ছে। ফলে অনেকেই রাগ করে কাজ ছাড়ছে। তিনি আরও বলেন, অনেক শিডিউলের বাইরেও লোডশেডিং হচ্ছে। এসব পরিস্থিতি মোকাবিলায় সরকার অন্য কোনোপদক্ষেপ নেওয়া হলে হয়তো শিল্প মালিকদের সুবিধা হবে। রাসেল গার্মেন্টসের সহকারি মার্চেন্ডাইজার সাজন বলেন, এখানে তেমন কোনো সমস্যা হয়নি। তবে সা¤প্রতিক সময়ে কাজ কিছুটা কম হচ্ছে। আর এস কম্পোজিটের প্রোপ্রাইটার মোর্শেদ সারোয়ার সোহেল বলেন, এ মুহূর্তে গ্যাস অনেক বড় সংকট। বিদ্যুৎ সংকট কিছুটা জরিমানা দিয়ে আমরা পার পেয়ে যাচ্ছি। কারণ প্রত্যেক কারখানায়ই জেনারেটর রয়েছে। তাতে জরিমানা গুনতে হচ্ছে। এরপরও সেটা কোনোরকম মোকাবিলা করা যাচ্ছে। তবে গ্যাস সংকট মোকাবিলা কঠিন হয়ে যাচ্ছে। বাংলাদেশ নিটওয়্যার ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যান্ড এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিকেএমইএ) সহ-সভাপতি (অর্থ) মোর্শেদ সারোয়ার সোহেল বলেন, যে কোনো শিল্পখাতেই লোডশেডিংয়ের কারণে প্রভাব পড়ে থাকে। আমাদের ক্ষেত্রেও ব্যতিক্রম নয়। তবে আমাদের ক্ষেত্রে আরেকটু বেশি সমস্যা হচ্ছে। যেহেতু এক্সপোর্ট করি। এক্সপোর্টের জন্য প্রত্যেকটি জিনিসের বাইন্ডিং থাকে। সময় মতো যখন শিপমেন্ট করতে না পারবো তখন এ পণ্য বাতিল হয়ে যাবে। এতে সার্বিকভাবে দেশেরই লস। ব্যবসায়ীদের পাশাপাশি দেশও ক্ষতিগ্রস্ত হয়। তিনি আরও বলেন, সার্বিকভাবে শুধু দেশ নয় বিশ্বব্যাপীই এ সংকট চলছে। তাতে লোকাল ব্যবসায়ীদের থেকে এক্সপোর্টারের ওপর প্রভাবটা বেশি পড়ে। এক্ষেত্রে সরকার আমাদের অনেকভাবেই সহযোগিতা করছে। সেই সহযোগিতায় এখনো টিকে আছি। তবে সরকার বিশেষ নজর দিলে আরেকটু এগিয়ে যেতে পারবো। এ সেক্টরের উন্নতি হলে সব সেক্টরেই সেই উন্নয়ন ছড়িয়ে পড়বে। বাংলাদেশ নিটওয়্যার ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যান্ড এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিকেএমইএ) নির্বাহী সভাপতি মোহাম্মদ হাতেম বলেন, কারখানাগুলো লোডশেডিংয়ের এলোমেলো তথ্য দিচ্ছে। এভাবে চলতে থাকলে উৎপাদন ব্যয় বাড়বে। ব্র্যান্ড ক্রেতারা পোশাকের দরে এক সেন্টকেও খুব গুরুত্ব দেন। কম পেলে রপ্তানি আদেশ সরিয়ে নিতে বিন্দুমাত্র ভাববে না। লোডশেডিংয়ের শিডিউল মানা গেলে স্বাভাবিক কর্মঘণ্টার আগে-পরে অথবা ছুটির দিনে কাজ করিয়ে ক্ষতি পোষানো সম্ভব হতো। এমনিতেই অর্ডার কম, যেসব অর্ডার রয়েছে সেগুলো সময়মতো শিপমেন্ট করতে না পারলে হাতছাড়া হয়ে যাবে। বিসিক নারায়ণগঞ্জের সহকারি মহা-ব্যবস্থাপক (ভারপ্রাপ্ত) মুহাম্মদ আশিকুর রহমান বলেন, বেশিরভাগ কারখানায় ২৪ ঘণ্টা কাজ চলমান। যে সময় লোডশেডিং থাকে সে সময় তারা বিকল্প ব্যবস্থা কিংবা জেনারেটর ব্যবহার করেন। এর বাইরে সরাসরি কোনো প্রভাব নেই। বিকল্প ব্যবস্থার কারণে ডিজেল খরচ বাড়বে। এক ঘণ্টা লোডশেডিং হলে বেশি প্রভাব পড়ার কথা না। যদি লোডশেডিং দীর্ঘমেয়াদি হয় তাহলে হয়তো প্রভাব পড়তে পারে। ঢাকা পাওয়ার ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি লিমিটেড (ডিপিডিসি) নারায়ণগঞ্জের নির্বাহী প্রকৌশলী গোলাম মোর্শেদ বলেন, নারায়ণগঞ্জে ৪ ভাগে লোডশেডিংয়ের শিডিউল করা হয়েছে। এর মধ্যে কিছু এলাকা ২ ঘণ্টা এবং কিছু এলাকায় ১ ঘণ্টা করে লোডশেডিংয়ের শিডিউল রয়েছে। যেসব এলাকায় শিল্প কারখানা আছে সে এলাকার বিষয়টি আলাদাভাবে বিবেচনায় নিয়ে লোডশেডিংয়ের শিডিউল করা হয়েছে।
গোপনীয়তা নীতি | এই ওয়েবসাইটের কোন লেখা, ছবি, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি।