দেশের আলো রিপোর্ট
চলতি মাসের ৫ তারিখ মধ্যরাতে হঠাৎ করেই জ¦ালানী তেলের অবিশ^াস্য নারায়ণগঞ্জের বাসযাত্রীরা পরিবহন মালিকদের কাছে জিম্মি হয়ে পড়েছেন। সরকার নির্ধারিত ভাড়ার পরিবর্তে নিজেদের ইচ্ছেমতো বর্ধিত বাস ভাড়া আদায় করছেন মালিক পক্ষ। সরকারতেলের মূল্য বাড়ানোর সাথে নির্ধারণ করে দিয়েছে যাত্রীবাহী পরিবহনের ভাড়াও। কিন্তু নির্ধারিত সেই ভাড়ার চেয়েও অতিরিক্ত ভাড়া আদায় করছে নারায়ণগঞ্জের পরিবহন মালিকরা। বিশেষ করে নারায়ণগঞ্জ-ঢাকা সড়কের যাত্রীরা অনেকটাই জিম্মি। এ অবস্থায় অতিরিক্ত এ ভাড়া আদায় জুলুম বলে আখ্যায়িত করছে সচেতন মহল। সরকারের নির্দেশ বাস্তবায়ন না করায় দোষারোপ করছেন জেলা প্রশাসন ও বিআরটিএ এর মতো সংশ্লিষ্ট সংস্থা গুলোর নীরবতা। এ ব্যাপারে বিআরটিএ বলছেন, খুব দ্রæতই নারায়ণগঞ্জ থেকে ঢাকার দূরত্ব ঠিক কতটুকু সেটা মেপে, ভাড়া নির্ধারণ করে দেওয়া হবে।
৫ আগস্ট জ্বালানী তেলের মূল্য বৃদ্ধি করে সরকার। সাথে বাড়তি ভাড়াও কিলোমিটার প্রতি ২ টাকা ৪০ পয়সা নির্ধারণ করে দেওয়া হয়। নারায়ণগঞ্জ যাত্রী অধিকার সংরক্ষন ফোরামের হিসেব মতে, নারায়ণগঞ্জ থেকে ঢাকার দূরত্ব ১৯ কিলোমিটার পথে ভাড়া আসে ৪৫ টাকা। মেয়র হানিফ ফ্লাইওভারের টোল বাবদ আরও ৫ টাকা মিলে ৫০ টাকা হতে পারে। কিন্তু পরিবহন মালিকরা ঢাকা-নারায়ণগঞ্জের দূরত্ব ২৩ কিলোমিটার দাবি করে, প্রথমে ৬৫ টাকা বাড়িয়েছিল। পরে সমালোচনার মুখে ৫ টাকা কমিয়ে ৬০ টাকা ভাড়া নির্ধারণ করে। এ প্রসঙ্গে সাংবাদিক তোফাজ্জল হোসেন বলেন, নারায়ণগঞ্জের বাস মালিকরা একটি সংঘবদ্ধ গোষ্ঠী। এই গোষ্ঠীর নেপথ্যে একজন সংসদ সদস্যের হাত আছে। মূলত সেই কারণেই নারায়ণগঞ্জের প্রশাসন বাস মালিকদের ঘাটায় না। তেলের মূল্য বৃদ্ধির পর ঢাকার সচিবালয়ে বাস মালিক ও অন্যান্য সংগঠনের সাথে কথা বলেছে। তবে নারায়ণগঞ্জের জেলা প্রশাসক এ বিষয়ে একটি মিটিং ডাকারও সাহস পায় নাই বা তারা যোগ্যতা রাখে না। নারায়ণগঞ্জের প্রশাসন সম্পূর্ন ব্যর্থ। এমনকি নারায়ণগঞ্জের এমপি ও মেয়রও জনগনের পাশে এরকম কঠিন একটা সময়ে এসেও দাঁড়ায়নি। বাংলাদেশ প্রতিদিনের জেলা প্রতিনিধি ও নারায়ণগঞ্জ সদর থানা কমিউনিটি পুলিশিং এর সাধারণ সম্পাদক নোমান চৌধুরী জানান, এ ভাবে বাস ভাড়া বৃদ্ধি জনগণের উপর প্রকাশ্য জুলুম। সরকারের নির্ধারিত ভাড়ার বাইরে গিয়ে কেন এত টাকা বৃদ্ধি করা হচ্ছে, বাস মালিকদের এ প্রশ্নের উত্তর পরিষ্কার করতে হবে। প্রজ্ঞাপন অনুযায়ী, নির্ধারিত বাস ভাড়া জেলা প্রশাসন ও বিআরটিএ বাস্তবায়ন করবে। কিন্তু নারায়ণগঞ্জে কোন মনিটরিং না হওয়াটা দায়িত্ব হীনতার পরিচয়।
সাংবাদিক মুন্না খান বলেন, যারা বেসরকারি ভাবে বাস চালায় তোরা কোন না কোন ভাবে রানীতির সাথে সংশ্লিষ্ঠ। তাই এখানে চাঁদাবাজির ইস্যূটা অটোমেটিক চলে আসে। আর এই নিয়ে বাসের যাবতীয় যত খরচ আছে তা বাস মালিকরা যাত্রীদের ঘারে চাপায় দেয়। নারায়ণগঞ্জের অধিকাংশ বাস, লেগুনাগুলো কিন্তু গ্যাসে চলে, তার পরেও তেলের দাম বাড়লে তারা ভাড়া বাড়িয়ে ফেলে। আর এটা সম্পূর্ণ রূপে অযৌক্তিক। ঢাকা-নারায়ণগঞ্জের দূরত্বটা অনেক কম। এতোটা বাস ভাড়া নেয়া একেবারেই উচিত না। আমি এই বিষয়ে দ্রæত প্রশাসনের হস্তক্ষেপ কামনা করি। তারা যাতে দ্রæত এ বিষয়ে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করেন। সাংবাদিক হাবিবুর রহমান বলেন, বর্ধিত বাসভাড়া কমানোর বিষয়ে জনপ্রতিনিধিদের এগিয়ে আসা দরকার। তা না হলে একটা শ্রেণী লাভবান হতে থাকবে আর আমাদের সাধারণ মানুষের পকেট খালি হবে। ভাড়া নির্ধারণের ক্ষেত্রে মূল দায়িত্ব হচ্ছে বিআরটিএ‘র। তবে, তারা বিশেষ এক শ্রেণিকে সুবিধা দিচ্ছে। নারায়ণগঞ্জের যাত্রীরা পরিবহন মালিকদের কাছে জিম্মি হওয়ার পেছনে বিআরটিএ দায়ী। দৈনিক দেশ রূপান্তরের জেলা প্রতিনিধি কমল খান জানান, সরকার যাত্রীবাহী পরিবহনের ভাড়া কিলোমিটার প্রতি নির্ধারণ করে দিয়েছে। সেটার থেকে বেশি আদায় করাই হচ্ছে জুলুম। আমি মনে করি, জেলা প্রশাসন ও পুলিশ বাস মালিকদের সাথে সমন্বয় করে সরকার নির্ধারিত ভাড়া নির্ধারণ করে দিতে পারে। এ বিষয়ে জানতে চাইলে পরিবহন ব্যবসায়ী কামাল মৃধা জানান, ঢাকা-নারায়ণগঞ্জ রুটে চলাচলরত উৎসব-বন্ধন পরিবহনের রোড পারর্মিট নেই। সেই অবৈধ পরিবহন মালিকরা কি ভাবে জেলা প্রশাসকের সাথে আলাপ করবে? বিআরটিএ সবকিছু জেনেও কি ভাবে অবৈধ এই পরিবহন গুলো রাস্তায় চলাচল করতে দেয়। এদিকে বাসভাড়া কমানোর দাবিতে প্রতিনিয়তই নারায়ণগঞ্জে মানববন্ধন, সংবাদ সম্মেলন ও স্মারকলিপি প্রদান করা হচ্ছে। বিএনপি থেকে শুরু করে বিভিন্ন বাম সংগঠনের নেতৃবৃন্দ ভাড়া কমানোর দাবিতে আওয়াজ তুলছেন। তবে সব কিছুর পরেও দেখা মিলছেনা ভাড়া কমানোর কোন লক্ষণ। আর এই কারণে ক্ষুব্ধ অনেকেই। বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি নারায়ণগঞ্জ জেলা সভাপতি হাফিজুল ইসলাম বলেন, অযৌক্তিক ভাবে নারায়ণগঞ্জে পরিবহনের ভাড়া বৃদ্ধি করেছে মালিকরা। এখন সরকারের নির্দেশ কার্যকর করার দায়িত্ব প্রশাসনের। ডিসি মহোদয় মালিক সমিতির সাথে বসেছেন, সেখানে আমাদের প্রতিনিধিও ছিল। আমরা বলেছি, কোন অবস্থাতেই ৫০ টাকার ১ টাকাও বেশি ভাড়া বাড়ানোর সুযোগ নাই। নারায়ণগঞ্জ জেলা বিএনপির সদস্য সচিব অধ্যাপক মামুন মাহমুদ বলেন, পরিবহন ব্যবসার আড়ালে অনেকেরই রাজনৈতিক পরিচয় রয়েছে। এর সাথে প্রশাসনের কতিপয় সদস্যদের যোগসাজশ রয়েছে। তাই অতিরিক্ত ভাড়া আদায় হলেও প্রশাসনের কোন ভূমিকায় দেখা যাচ্ছে না। এছাড়া অনেকই চাঁদা দিতে হয়, আছে ভাগবাটোয়ারার ব্যাপারও। তাই অতিরিক্ত ভাড়া চাপিয়ে দেওয়া হচ্ছে জনগণের উপর। ক্ষোভ প্রকাশ করে নারায়ণগঞ্জ মহানগর বিএনপির সাংগঠনিক সম্পাদক এড. আবু আল ইউসুফ খান টিপু বলেন, সরকার সারাদেশের পরিবহনের ভাড়া নির্ধারণ করে দিয়েছে। সে অনুযায়ী পরিবহনগুলো চলছে। কিন্তু নারায়ণগঞ্জ বাংলাদেশের মানচিত্রের বাইরে, তাই বাস্তবায়ন হয়নি। নারায়ণগঞ্জ-ঢাকা পথের বাস ভাড়া বৃদ্ধির অন্যতম কারণ চাঁদাবাজী বলে অনেকেই বিভিন্ন সভা সমাবেশে দাবি করেন। তবে, ভিন্ন মত ক্ষমতাশীন দলের নেতাদের।চাঁদাবাজীর বিষয়ে নারায়ণগঞ্জ মহানগর আওয়ামী লীগের যুগ্ম সম্পাদক শাহ্ নিজাম বলেন, কাল্পনিক কথা বলে তো আসলে লাভ নেই। প্রমাণ থাকলে উপস্থাপন করেন। সরকার থেকে নির্ধারিত ভাড়ার অতিরিক্ত নিলে দেখার দায়িত্ব জেলা প্রশাসন ও পুলিশ প্রশাসনের। যারা ভাড়া কমানোর দাবিতে আন্দোলন করছেন, তাদের আন্দোলনের জন্য যেন, জাতীয় সম্পদের ক্ষতি না হয় সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে। অতিরিক্ত বাস ভাড়া নিয়ন্ত্রণের বিষয়ে নারায়ণগঞ্জ মহানগর আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক জাকিরুল আলম হেলাল বলেন, প্রশাসনের কাছে আমার অনুরোধ থাকবে, আপনারা এটা একটু নজর দেন। আপনারা একটু নিয়ন্ত্রণ করেন। বিআরটিএ নারায়ণগঞ্জ জেলার সহকারি পরিচালক মো. শামসুল কবীর জানান, আমাদের সাথে কোন রকম আলোচনা ছাড়াই বাস মালিকরা ভাড়া বৃদ্ধি করেছে। আমরা এ বিষয়ে অভিযানও পরিচালনা করেছি এবং যাত্রীদের কাছ থেকে নেয়া অতিরিক্ত ভাড়া যাত্রীদের ফিরিয়ে দিয়েছি। বাস মালিকদের নিয়ে ১৪ আগস্ট আলোচনায় বসে নারায়ণগঞ্জ জেলা প্রশাসক। যদিও ওই সভায় বাস ভাড়া কত কমানো হবে সেটি পরিষ্কার হয়নি। সিদ্ধান্ত হয়েছে, মঙ্গলবার (১৭ আগস্ট) নারায়ণগঞ্জ থেকে ঢাকার দূরত্ব ঠিক কতটুকু সেটা মেপে ভাড়া নির্ধারণ করে দেওয়া হবে।
গোপনীয়তা নীতি | এই ওয়েবসাইটের কোন লেখা, ছবি, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি।