নিজস্ব সংবাদদাতা
নারায়ণগঞ্জের সর্বত্র চুরি, ডাকাতি, ছিনতাই নিত্যদিনের ঘটনা হয়ে দাঁড়িয়েছে। গত ৩ মাসে গণমাধ্যমে প্রকাশিত তথ্যে ১৪টি ছিনতাইয়ের ঘটনা ঘটেছে এবং ছিনতাইকারীদের হাতে নৃশংসভাবে খুন হয়েছে ৫ জন। তবে ভেতরের চিত্র ভিন্ন। প্রতিদিনই জেলা বিভিন্ন এলাকায় ছিনতাইয়ের ঘটনা ঘটছে। পুলিশি ঝামেলা এড়াতে ভুক্তভোগীরা আইনের আশ্রয় নিচ্ছেন না। ফলে অসংখ্য ছিনতাইয়ের ঘটনা আড়ালে রয়ে যাচ্ছে। বিশেষ করে গার্মেন্টস শ্রমিকরা প্রতিনিয়তই ছিনতাইয়ের কবলে পড়ছেন। মোবাইল ও টাকা-পয়সা হাতিয়ে নিয়ে যাচ্ছে। কেউ না দিতে চাইলে করা হচ্ছে ছুরিকাঘাত। এতে কেউ রক্তাক্ত জখম হয়ে আহত হচ্ছে আবার কেউ মারা যাচ্ছে। আইনশৃংখলাবাহিনীর তৎপরতা না থাকায় বীরদর্পে ছিনতাইকারীরা তাদের কার্য সম্পাদন করছে। অভিযোগ রয়েছে, অপরাধ দমনের চেয়ে পুলিশ সামারি বাণিজ্যে বেশি ব্যস্ত থাকছে। আবার অপরাধীদের সঙ্গে পুলিশের সখ্যতাও ওপেন সিক্রেট। মজার বিষয় হলো, পুলিশের ওপেন হাউজ ডে এর অনুষ্ঠানগুলোতেও তেল চোর, মাদক্য ব্যবসায়ীর শেল্টারদাতা, ভূমিদস্যু, পরিবহন চাঁদাবাজদের সরব উপস্থিত দেখা যায়। ফলে ভুক্তভোগীরা অপরাধীদের বিরুদ্ধে মুখ খুলতে বা প্রতিবাদ করতে সাহস করছে না। বিশেষ করে গভীর রাত ও ভোরের নারায়ণগঞ্জ এক আতঙ্কের জনপদে পরিণত হয়। এর সর্বশেষ দৃষ্টান্ত ফতুল্লার ফেইম অ্যাপারেলস লিমিটেডের কর্মচারি জয়নুর রহমান জনি। কর্মস্থলে যোগ দেয়ার জন্য শনিবার (২৯ অক্টোবর) ভোরে কুষ্টিয়া থেকে চাষাঢ়া এসে বাড়ি যাওয়ার পথে সরকারি মহিলা কলেজের সামনে ছিনতাইকারীদের কবলে পড়ে মর্মান্তিকভাবে প্রাণ হারান তিনি। ছিনতাইকারীরা তাকে ছুরিকাঘাত করে পালিয়ে যান। দীর্ঘ সময় রক্তাক্ত অবস্থায় পড়ে থাকায় তিনি মারা যান। কেবল জনি নয়, ছিনতাইকারীদের কবলে নৃশংস মৃত্যুর ঘটনা হরহামেশাই ঘটছে। গনমাধ্যমের সূত্রানুসারে, গত তিন মাসে ভয়াবহ ছিনতাইয়ের ঘটনা ঘটেছে ১৫টি। এরমধ্যে ছিনতাইয়ের কবলে পরে ৫ জনের মৃত্যু হয়েছে। এছাড়াও ছোট ছোট অগনিত ছিনতাইয়ের ঘটনা ঘটছে একাধিক স্থানে। অধিকাংশ ক্ষেত্রে ছিনতাইয়ের মুহুর্তে ছিনতাইয়ের শিকার মানুষটি পুলিশের সাহায্য পায় না। ছিনতাইয়ের পরও পুলিশের তেমন কিছু করার থাকে না। কারণ, অধিকাংশ ক্ষেত্রেই হয় না মামলা। ছিনতাইকারীদের প্রধান টার্গেট হয়ে দাঁড়িয়েছে ইজিবাইক চালক ও নৈশ্যপ্রহরীরা। এছাড়াও মধ্যরাত হলেই জেলার একাধিক স্থল হয়ে উঠে তাদের শিকারস্থল। ৭ অক্টোবর একই দিনে সিদ্ধিরগঞ্জ ও আড়াইহাজারে ছিনতাইকারীদের কবলে পরে দু’জনের মৃত্যু হয়। সিদ্ধিরগঞ্জের ৪নং ওয়ার্ডে ছিনতাইকারীদের ছুরিকাঘাতে সুজন মিয়া নামে এক ইজিবাইকচালকের মৃত্যু হয়। এ ঘটনায় মো. ইব্রাহীম ওরফে রানা ও রহমত আলী নামে দু’জনকে গ্রেফতার করেছে র্যাব। আড়াইহাজারের ঝাউগড়া নামক স্থানে ছিনতাইকারীর ছুরিকাঘাতে মোমেন মোল্লা নামে এক কাঁচামাল ব্যবসায়ী নিহত হয়েছেন। একইমাসে আরো ৩টি ছিনতাইয়ের ঘটনা ঘটে। ৩০ অক্টোবর সকালে শহরের লঞ্চ টার্মিনাল এলাকায় দুলাল নামের এক ভ্যান চালককে ছুরিকাঘাত করে মারাত্মকভাবে আহত করে স্থানীয় ছিনতাইকারীরা। ১৩ অক্টোবর ফতুল্লার পঞ্চবটি এলাকায় অটোরিকশা ছিনতাইকালে ২ ছিনতাইকারীকে আটক করে গণপিটুনি দিয়ে পুলিশে হস্তান্তর করে স্থানীয় পথচারীরা। আটককৃত ছিনতাইকারীরা হলো, দেওভোগ মাদ্রাসার সামছুলের বাড়ির ভাড়াটিয়া শাহিনের পুত্র সোয়াত ও একই এলাকার লিয়ন মিয়ার ভাড়াটিয়া সুমন মিয়ার ভাড়াটিয়া ইমন। ৪ অক্টোবর দিবাগত রাতে চানমারি এলাকায় সিএনজি চালক মাসুদ রানাকে মারধর করে তার সিএনজি ছিনিয়ে নিয়ে যায়। পরদিন ছিনতাই হওয়া সিএনজি মুন্সিগঞ্জ থেকে উদ্ধার করে পুলিশ। সেসময় ২ ছিনতাইকারীকে গ্রেফতার করা হয়।
সেপ্টেম্বর মাসে ৫টি ছিনতাইয়ের ঘটনা ঘটে। এরমধ্যে একটি ঘটনায় একজনের মৃত্যু হয়। ২৮ সেপ্টেম্বর বন্দর উপজেলায় মিশুকচালক কায়েসকে গলাকেটে হত্যা করে ছিনতাইকারীরা। মদপান করিয়ে তার মিশুক ছিনতাই করে ঘাতকরা। এই হত্যাকান্ডে জড়িত ৫ জনের মধ্যে ৩ জনকে গ্রেফতার করেছে পুলিশ। ছিনতাইকারীরা কতটা ভয়াবহ হয়ে উঠেছে তার প্রমান মিলে এ ঘটনায়, কেবল সাধারন মানুষ নয় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী ব্যক্তিরা তাদের শিকার হচ্ছে। ২৬ সেপ্টেম্বর মাসদাইরে ছিনতাইকারীদের কবলে পরে মোবাইল ফোন ও টাকা খুইয়েছেন জেলা গোয়েন্দা পুলিশের এক কনস্টেবল। চাপাতি ও ধারালো অস্ত্রের ভয় দেখিয়ে তার নিকট থেকে মোবাইল ফোন ও নগদ অর্থ ছিনিয়ে নেয় ছিনতাইকারীরা। এ ঘটনায় জেলা গোয়েন্দা পুলিশ তৎক্ষনাৎ নিজস্ব গোয়েন্দা ও তথ্য প্রযুক্তি ব্যবহার করে জড়িত ৩ ছিনতাইকারীকে গ্রেফতার করে। ১৯ সেপ্টেবর ফতুল্লার সস্তাপুর বটতলাস্থ এলাকায় সিএনজি চালককে আটকে রেখে টাকা ও সিএনজি ছিনতাই করে পালিয়ে যাওয়ার সময় ৭ ছিনতাইকারীকে গ্রেফতার করে পুলিশ। আগেরদিন সিদ্ধিরগঞ্জের হীরাঝিল এলাকায় ইমরান নামের এক ব্যবসায়ীকে মারধর করে ২ লাখ টাকা ছিনতাইয়ের ঘটনা ঘটে। ৫ সেপ্টেম্বর ফতুল্লায় ছিনতাইকালে ৪ ছিনতাইকারীকে আটক করে গণপিটুনী দিয়ে পুলিশে সোপর্দ করেছে স্থানীয় এলাকাবাসী। তল্লার আজমেরী বাগস্থ জমজম টাওয়ারের সামনে নৈশপ্রহরীকে ছুরির ভয় দেখিয়ে ছিনতাই কালে তাদেরকে আটক করা হয়। আগের দিন ঢাকা-নারায়ণগঞ্জ লিংকরোডের জালকুড়ি এলাকায় ট্রাক চালককে কুপিয়ে টাকা ছিনিয়ে পালিয়ে যাবার সময় স্থানীয় পথচারীদের সহায়তায় এক ছিনতাইকারীকে গ্রেফতার করে পুলিশ। আগস্ট মাসে ছিনতাইয়ের ঘটনায় একজনের মৃত্যু হয়। এছাড়াও আরো দু’টি আলোচিত ছিনতাইয়ের ঘটনা ঘটে। ১৭ আগস্ট ফতুল্লার পূর্ব শিয়াচরে লালখা এলাকায় পাগলা জসীম ও তার সহোযোগিরা প্রকাশ্যে মালুম চাঁন নামক এক মুদী ব্যবসায়ীকে কুপিয়ে রক্তাক্ত জখম করে ২ লাখ টাকা ছিনিয়ে নেওয়ার ঘটনা ঘটে। ১৪ আগস্ট ঢাকা-নারায়ণঞ্জ লিংক রোডের নতুন কোর্ট এলাকায় বিআইডবিøউটিএ সিবিএ নারায়ণগঞ্জ শাখার চেয়ারম্যান সিদ্দিকুর রহমানের কাছ থেকে ৩৭ হাজার টাকা ছিনতাই করে দুর্বৃত্তরা। ১২ আগস্ট ফতুল্লায় চালক দুলালকে ছুরিকাঘাতে হত্যার পর রিকশা ছিনতাই করে নিয়ে যায় দুর্বৃত্তরা। জেলা পুলিশ সুপার কার্যালয়ের কাছে চানমারী এলাকায় এ ঘটনা ঘটে। এ ঘটনায় সন্দেহভাজন আসামী পেশাদার ছিনতাইকারী হামজা লিংকনসহ ২ ছিনতাইকারীকে প্রেফতার করেছে পুলিশ। গ্রেফতার ছিনতাইকারীদের কাছ থেকে ছুরি, চাপাতিসহ ধারালো অস্ত্র উদ্ধার করা হয়েছে। এ থেকেই অনুমান করা যায়, ছিনতাইকারীরা কতটা বিপজ্জনক হয়ে উঠেছে। ছিনতাইকারীদের দৌরাত্ম্য পুলিশের টহল বাড়ানোর মাধ্যমে পুলিশি সক্রিয়তা দৃশ্যমান করা জরুরি বলে মনে করছেন সচেতনমহল। নারায়ণগঞ্জ পুলিশ সুপার গোলাম মোস্তফা রাসেল এ বিষয়ে বলেন, নারায়ণগঞ্জে কেবল ছিনতাই নয়, সকল ধরণের অপরাধ দমনে তৎপর রয়েছে জেলা পুলিশ। ছিনতাইয়ের ঘটনায় থানায় মামলা কিংবা তাৎক্ষনিকভাবেও যদি পুলিশ খবর পায়, সেক্ষেত্রে দ্রæত ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে অপরাধীদের বিরুদ্ধে। এসব অপরাধ নিয়ন্ত্রণে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থাসহ রাতে বাড়তি টহল দিয়ে মানুষের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা হবে।
গোপনীয়তা নীতি | এই ওয়েবসাইটের কোন লেখা, ছবি, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি।