Logo
HEL [tta_listen_btn]

অস্তিত্ব সংকটে হারিয়ে যাচ্ছে ঐতিহ্যের খাদি কাপড়

মাহবুবুল ইসলাম সুমন
তুলার দুষ্প্রাপ্যতা, লোকবলের অভাব ও উন্নত প্রযুক্তির মেশিনারিজের প্রভাবে অস্তিত্ব সংকটে হারিয়ে যেতে বসেছে কুমিল্লা অঞ্চলের ঐতিহ্যবাহী খাদি কাপড়। দেশের লুপ্তপ্রায় গ্রামীণ ঐতিহ্যের মধ্যে এটিও একটি। পা চালিত খাদের তাঁতে হাতে তৈরী খাদি কাপড়ের চাহিদা কিছুটা থাকলেও মজুরি তেমন না পাওয়ায় খাদি কাপড় তৈরী থেকে সরে যাচ্ছে কারিগরেরা। আরো নানাবিধ কারণে অস্তিত্ব হারাচ্ছে এই আদি ঐতিহ্য। অখন্ড ভারতে বৃটিশ বিরোধী মহাত্মা গান্ধীর অসহযোগ আন্দোলনের সময়ে দ্রুত বিস্তার ও জনপ্রিয়তা অর্জন করা চরকায় সুতা কাটা স্বহস্তে তৈরী স্বদেশী পণ্য ঐতিহ্যবাহী খাদি শিল্প এখন বিলুপ্তির পথে। এই ঐতিহ্যের পরিচিতি প্রসারে নারায়ণগগঞ্জের সোনারগাঁয়ে মাসব্যাপী লোককারুশিল্প মেলা ও লোকজ উৎসবে এবারই প্রথম তাদের স্থান দেয়া হয়েছে।
বাংলাদেশ লোক ও কারুশিল্প ফাউন্ডেশন কর্তৃক আয়োজিত মাসব্যাপী লোককারুশিল্প মেলা ও লোকজ উৎসবে কারুপণ্য প্রদর্শনী গ্যালারীর পূর্ব দিকে গেলে দেখা যায় কুমিল্লা থেকে আসা খাদি কাপড়ের স্টল। সেখানে বসে খাদি কাপড় বুননের কাজ করছেন শ্রী চিন্তাহরণ দেবনাথ। পাশে বসে সহযোগিতা করছেন মেয়ে ববিতা রানী বিশ্বাস ও নাতনী অনন্যা বিশ্বাস। স্টলে সাজানো রয়েছে পায়ে চালিত খাদের তাঁতে তৈরী গায়ের চাদর, ওড়না, ফতুয়া, পাঞ্জাবি ও বিছানার চাদর। ঐতিহ্যবাহী খাদির এই স্টলে পর্যটক আসলেও ক্রেতা তেমন নেই বললেই চলে। লোককারুশিল্প মেলা ও লোকজ উৎসবে ঢাকা, কুমিল্লা ও রাজশাহী থেকে আসা পর্যটক সাংবাদিক সাহিত্যিক আল আমিন সেলিম, কন্ঠশিল্পী মনিরা আক্তার, বর্ষা ইসলাম, শিক্ষার্থী রাজন, সৌমেন ও রাজশ্রীসহ কয়েকজন জানান, প্রাচীনকাল থেকে এই উপ-মহাদেশে হস্তচালিত তাঁতশিল্প ছিল জনবিখ্যাত। মহাত্মা গান্ধী যখন ১৯২০ সালে স্বদেশী আন্দোলনে বিলেতী পণ্য বর্জনের ডাক দেন মূলত সেই সময়ে খাদি কাপরের জনপ্রিয়তা ও বিস্তার লাভ শুরু হয়। পরবর্তিতে ১৯২১ সালে মহাত্মা গান্ধী কুমিল্লায় আসেন এবং সেখানে স্বহস্তে চরকায় সূতা কাটা ও তাঁতে খাদি কাপর বুননের দিক নির্দেশনা দেন। তখন থেকে কুমিল্লার চান্দিনা, ময়নামতি, গৌরীপুর, দেবীদ্বার ও বুড়িচংসহ কয়েকটি এলাকার দেবনাথ (যুগী) পরিবার পুরোদমে শুরু করেন খাদি কাপর বুুননের কাজ। তারা তৈরী করেন লুঙ্গি, গামছা, শড়ি, ওড়না ইত্যাদি। তখন থেকে দেশে কুমিল্লার খাদি কাপড় ব্যাপক জনপ্রিয় হয়ে উঠে। বর্তমানে খাদের তাঁতে বুনন করা মোটা খাদি কাপড় পাওয়া যায়না। মাসব্যাপী লোককারুশিল্প মেলা ও লোকজ উৎসবে কুমিল্লার চান্দিনা থেকে খাদি কাপড়ের প্রদর্শনী নিয়ে আসা ববিতা রানী বিশ্বাস জানান, বংশ পরম্পরায় খাদি কাপড় বুুুুুুুুুুুননের কাজ করেন তারা। বাবা চিন্তাহরণ দেবনাথ খাদি কাপড় বুনেই সংসারের হাল ধরে রেখেছিলেন। কিন্তু বর্তমান সময়ে পাওয়ারলুম আর উন্নত যন্ত্রপাতির তৈরী চিকন সুতার কাপড়ে বাজার হারিয়েছে খাদি কাপড়। তার স্বামী অমর বিশ্বাস ও মেয়ে অনন্যা বিশ্বাস জানান, রাঙামাটির তুলা থেকে চরকায় সূতা কেটে মাটিতে খোঁড়া খাদে বা গর্তে পায়ে প্যাডেল চালিয়ে হাতে বুনন করা হয় খাদি কাপড়। বর্তমানে তুলার দুষ্প্রাপ্যতা রয়েছে। এছাড়াও সারাদিন খাদি বুননের কাজ করে কারিগরেরা মজুরি পান ৩ থেকে ৪ শ’ টাকা, যা দিয়ে তাদের সংসার চালানো সম্ভব হয়না। তাছাড়া মেশিনে তৈরী নকল খাদি বাজার দখল করায় খাদের খাদি কাপড় বাজার পাচ্ছেনা। চিকন সূতার চেয়ে মোটা সূতার খাদি কাপড়ের দাম বেশী। চরকায় কাটা সূতায় হাতের তাঁতে তৈরি কুমিল্লার খাদি এখন দুর্লভ। কুমিল্লা ছাড়াও ঢাকা, চট্টগ্রাম, খুলনা, রাজশাহীসহ বড় বড় শহরগুলোতেও বর্তমানে তৈরি কথিত এই খাদি বা খদ্দরের শার্ট, বিভিন্ন শাড়ি, থ্রী পিছ, খদ্দরের থান কাপড়, চাদর, ফতুয়া অল্প দামে বিক্রি হচ্ছে। কুমিল্লার খাদি বা খদ্দর নামে যে কাপড় বিক্রি হচ্ছে তা মেশিনে তৈরি সূতার কাপড়। প্রকৃত খাদি কাপড়ের মূল্য এসবের দ্বীগুন থেকে তিনগুন বেশি। বিশুদ্ধ খাদি বিভিন্ন দোকানের সাইনবোর্ডে দেখা গেলেও এখন আর বাজারে নেই। এই শিল্প এখন প্রায় বিলুপ্ত। খাদির নামে বাজারে যা পাওয়া যাচ্ছে তা অখাদি। শুধুমাত্র কুমিল্লার চান্দিনায় খাদের তাঁতের খাদি শিল্প এখনো কিছুটা টিকে থাকলেও অধিকাংশ তাঁতী পেশা পরিবর্তন করে অন্য পেশায় ঝুঁকে পড়ছেন। যথাযথ মজুরি ও মূল্যায়ন না থাকায় নিজেদের সন্তানেরাও খাদি বুননের কাজে না এসে অন্য পেশায় চলে যাচ্ছে। সরকারি পৃষ্ঠপোশকতা ছাড়া এই শিল্পকে আর বাঁচিয়ে রাখা সম্ভব হবেনা। এদিকে বাংলাদেশ লোক ও ফারুশিল্প ফাউন্ডেশনের উপ-পরিচালক একেএম আজাদ সরকার জানান ইতিহাস ঐতিহ্যের পাতায় খাদি বস্ত্রের বেশ প্রশংসা থাকলেও কালের বিবর্তনে তা হারিয়ে যেতে বসায় এর পুনরুদ্ধার, সংগ্রহ, সংরক্ষণ, প্রদর্শণ ও পরিচিতির লক্ষ্যে মাসব্যাপী লোককারুশিল্প মেলা ও লোকজ উৎসবে এবার তাদের আনা হয়েছে। তাদের জন্য রয়েছে শিল্পি সম্মানী। প্রতি বছর এই কারুশিল্প মেলা ও লোকজ উৎসবে তাদের ডাকা হবে খাদি বুনন ও প্রদর্শণের জন্য।


আপনার মতামত লিখুন :

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *


Theme Created By Raytahost.Com