Logo
HEL [tta_listen_btn]

মন্তব্য কলাম: বন্দরকেও সমান গুরুত্ব দেয়া হোক

ফরিদ আহমেদ রবি
নারায়ণগঞ্জের সার্বিক উন্নয়নের সাথে বন্দরের উন্নয়ন অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িত। পশ্চিমাঞ্চলে না রাখলেই নয়, এমন সব সরকারি-বেসরকারি অফিস সমূহ ছাড়া অন্যান্য স্থাপনা সমূহ বন্দর অঞ্চলে স্থানান্তর করলে তাতে সমগ্র নারায়ণগঞ্জের চিত্রই পাল্টে যাবে।
নারায়ণগঞ্জের জনপ্রতিনিধি, নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিসহ সংশ্লিষ্ট সকল কর্তৃপক্ষ আন্তরিকতা নিয়ে এগিয়ে আসলে আধুনিক নারায়ণগঞ্জের ধারণা শুধু কাগজ কলমে থাকবেনা, বাস্তবে রূপ নিবে, অবসান ঘটবে নারায়ণগঞ্জবাসীর দীর্ঘ প্রতীক্ষার।
নারায়ণগঞ্জ জেলাটি সিটি কর্পোরেশন, কয়েকটি পৌরসভা এবং ইউনিয়ন পরিষদ নিয়ে গঠিত হলেও পুরো জেলাটিই সুবিধাবঞ্চিত অঞ্চলের রূপ ধারণ করেছে। এর প্রধান কারণ অপরিকল্পিত শিল্পায়ন, আবাসন এবং নগরায়ণ। সাথে যুক্ত হয়েছে অপ্রতুল পরিষেবা মূলক কার্যক্রম। ৫টি উপজেলার দু’টির কিছু অংশ নিয়ে সিটি কর্পোরেশন গঠিত, বাকি অংশ ইউনিয়ন পরিষদের অন্তর্ভুক্ত। অপর ৩টি উপজেলার কিছু অংশ পৌরসভা কিছু অংশ ইউনিয়ন পরিষদ ভুক্ত। সিটি কর্পোরেশন, পৌরসভা বা ইউনিয়ন পরিষদ ভুক্ত সব অঞ্চলই শিল্প কারখানা এবং জনসংখ্যার আধিক্যে বসবাসের অযোগ্য শহর বা গ্রামে পরিণত হয়েছে। শহরাঞ্চল শহরের বৈশিষ্ট্য ধরে রাখতে পারেনি, একইভাবে গ্রামাঞ্চল হারিয়েছে তার প্রাকৃতিক বৈশিষ্ট্য। তাই একথা নির্দ্বিধায় বলা চলে, নারায়ণগঞ্জ জেলার পুরোটাই না শহর না গ্রাম এমন অবস্থায় রয়েছে। অপরিকল্পিত নগরায়ণ, আবাসন এবং শিল্পায়নের কারণে জেলার মূল শহর সিটি কর্পোরেশন পরিণত হয়েছে বসবাস অযোগ্য নগরীতে। সব ধরনের পরিবেশ দূষণে শহর গ্রাম নির্বিশেষে সমগ্র নারায়ণগঞ্জ দূষিত হয়ে পড়েছে। ক্রমবর্ধমান চাহিদার কারণে শিল্প কারখানা নারায়ণগঞ্জে বেড়েই চলেছে, সেই সাথে বাড়ছে আবাসনের চাহিদা, সমানতালে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে যানবাহনসহ আনুষাঙ্গিক অন্যান্য অবকাঠামো। তাই সময় এসেছে নারায়ণগঞ্জকে ঢেলে সাজানোর। সঠিক পরিকল্পনা অনুযায়ী নারায়ণগঞ্জকে দৃষ্টিনন্দন, পরিবেশবান্ধব, বসবাস উপযোগী একটি অঞ্চলে রূপ দেয়ার। এক্ষেত্রে প্রথমেই নজর দিতে হবে নারায়ণগঞ্জ মূল শহর অর্থাৎ সিটি কর্পোরেশনের দিকে। শহর সম্প্রসারণ এখন সময়ের দাবি। নদীর পশ্চিম অঞ্চলে সম্প্রসারণের আর তেমন কোন সুযোগ না থাকায় নজর দিতে হবে নদীর পূর্বাঞ্চল অর্থাৎ বন্দরের দিকে, বর্তমান সিটি কর্পোরেশন ১৮৭৬ সালের ৮ সেপ্টেম্বর নারায়ণগঞ্জ পৌরসভা হিসেবে কার্যক্রম শুরু করে। তখন থেকেই বন্দরের বড় একটি অংশ নারায়ণগঞ্জ পৌরসভার অন্তর্ভুক্ত। পর্যায়ক্রমে নারায়ণগঞ্জ পৌরসভা সিটি কর্পোরেশনে রূপান্তরিত হয় ২০১১ সালের ৫ মে। নারায়ণগঞ্জ পৌরসভার প্রথম কার্যালয় নদীর পূর্বপাড় তথা বন্দরেই ছিল। সে হিসেবে বন্দর নারায়ণগঞ্জের সবচেয়ে প্রাচীন নগর অঞ্চল সমূহের অন্যতম বলে বিবেচিত। সিটি কর্পোরেশনের অন্তর্ভুক্ত হলেও বন্দরের অনেক অঞ্চল প্রাপ্য নাগরিক সুবিধা থেকে বঞ্চিত। যে সমস্ত সুবিধা সমূহ ছিল তাও ধীরে ধীরে অবলুপ্ত হয়েছে। নারায়ণগঞ্জ পৌরসভার অধিকাংশ উন্নয়নকর্ম নদীর পশ্চিম তীরকে কেন্দ্র করেই আবর্তিত হয়েছে। সিটি কর্পোরেশনে রূপান্তরিত হওয়ার পর বন্দর অঞ্চলে প্রধান সড়কটি প্রশস্তকরণ ছাড়া আর তেমন কোনো উল্লেখযোগ্য কাজ হয়নি। জেলা শহর হিসেবে যত ধরনের সরকারি বা বেসরকারি অবকাঠামো থাকার কথা তার সবই পশ্চিম তীরে অবস্থিত। হোসিয়ারি শিল্পের জন্য জগৎ বিখ্যাত নারায়ণগঞ্জ, হোসিয়ারি শিল্পের বিকাশ বন্দরেই ঘটে। পরবর্তী সময়ে শিল্পটি নয়ামাটিতে স্থানান্তরিত হয়। পাট শিল্পের জন্য প্রাচ্যের ডান্ডিখ্যাত নারায়ণগঞ্জের পাট শিল্প কারখানার ষাট ভাগের অধিক বন্দর অঞ্চলেই অবস্থিত ছিল। শিক্ষাক্ষেত্রে বন্দর শুধু নারায়ণগঞ্জ মহকুমা বা জেলাতে নয় সারা দেশেই শীর্ষস্থানীয় অবস্থানে থাকতো। সেসব ঐতিহ্য কালের গর্ভে হারিয়ে গেছে। সময় এসেছে বন্দরের ভৌগলিক এবং অবকাঠামগত সুবিধা কাজে লাগিয়ে সমগ্র নারায়ণগঞ্জকে ঢেলে সাজানোর। বন্দরকে গুরুত্ব দিয়ে আধুনিক শহর বিনির্মাণ করা হলে মূল শহরের উপর চাপ কমবে। আবাসন, শিল্পায়ন এবং সরকারি অফিস আদালতের কিছু অংশ বন্দরে স্থানান্তরিত হলে নারায়ণগঞ্জ শহরটি যেমন চাপমুক্ত হবে তেমনি বন্দর ফিরে পাবে স্বীয় ঐতিহ্য। এক্ষেত্রে দু’পাড়ের যোগাযোগ সহজ করার লক্ষ্যে কদম রসুল সেতুর নির্মাণ কাজ যত দ্রুত শুরু ও শেষ করা সম্ভব ততই মঙ্গল। এমন লক্ষ্যে কাজ করলে শহরের পরিধি বাড়বে যা নারায়ণগঞ্জকে দিতে পারে সমৃদ্ধ আধুনিক শহরের মর্যাদা। দেশের সবচেয়ে উন্নত, সমৃদ্ধ সিটি কর্পোরেশন অথবা জেলা শহর হওয়ার সব উপাদান থাকা সত্ত্বেও নারায়ণগঞ্জ থমকে আছে নির্দিষ্ট গন্ডিতে। এর প্রধান কারণ সঠিক পরিকল্পনা প্রণয়ন এবং বাস্তবায়নের অভাব। নারায়ণগঞ্জের প্রতিটি গ্রামাঞ্চল আধুনিক সুযোগ-সুবিধা সংবলিত, বসবাস উপযোগী, শিল্প বান্ধব একটি অঞ্চলে পরিণত হতে পারে, প্রয়োজন সঠিক পরিকল্পনা এবং বাস্তবায়ন। এমন পরিকল্পনায় বন্দর এলাকাকে প্রাধান্য দিতে হবে। বন্দর উপজেলা পূর্বাংশে ব্রহ্মপুত্র নদ পর্যন্ত বিস্তৃত। যাতায়াত ব্যবস্থা উন্নত করার মাধ্যমে গ্রামীণ বৈশিষ্ট্য অক্ষূন্ন রেখেও শহরের পরিধি বর্ধিত করার যথেষ্ট সুযোগ রয়েছে। বন্দরে সিটি কর্পোরেশন বহির্ভুত অঞ্চল সমূহে এখনও চাষ উপযোগী অনেক জমি রয়েছে। বিভিন্ন কারণে চাষের অনুপযোগী হয়ে পড়া জমির পরিমাণও কম নয়। চাষ অনুপযোগী জমিতে পরিকল্পিতভাবে শিল্পায়ন সম্ভব। এমন কিছু জায়গা রয়েছে যেখানে আধুনিক আবাসন প্রকল্প বাস্তবায়ন সম্ভব। চাষ উপযোগী জমি সমূহ যেন কোন অবস্থাতেই শিল্পায়ন বা আবাসনের অন্তর্ভুক্ত না হয়ে পড়ে তাও পরিকল্পনায় থাকতে হবে। দেশের বিভিন্ন অঞ্চলের সাথে যোগাযোগের ক্ষেত্রে নারায়ণগঞ্জ শহরের পশ্চিমাঞ্চল অপেক্ষা পূর্বাঞ্চল অনেক সুবিধা জনক অবস্থানে রয়েছে, তাই যোগাযোগ ব্যবস্থার ক্ষেত্রে নদীর পূর্বাঞ্চলকে গুরুত্ব দেয়া হলে যুগান্তকারী পরিবর্তন আসবে যোগাযোগ ব্যবস্থায়। বর্তমান নারায়ণগঞ্জ শহর অনেকটাই যানজটমুক্ত শহরে পরিণত হবে। পশ্চিমাঞ্চলে না রাখলেই নয় এমন সব সরকারি-বেসরকারি অফিস সমূহ ছাড়া অন্যান্য স্থাপনা সমূহ বন্দর অঞ্চলে স্থানান্তর করলে তাতে সমগ্র নারায়ণগঞ্জের চিত্রই পাল্টে যাবে।
শিল্প-বাণিজ্য সমৃদ্ধ নারায়ণগঞ্জ সারা দেশের জন্যই অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। সুদীর্ঘ কাল যাবত এ জেলা জাতীয় অর্থনীতিতে বিশেষ অবদান রেখে চলেছে। জাতীয় স্বার্থেই নারায়ণগঞ্জের সার্বিক উন্নয়ন প্রয়োজন। নারায়ণগঞ্জের সার্বিক উন্নয়নের সাথে বন্দরের উন্নয়ন অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িত। নারায়ণগঞ্জের জনপ্রতিনিধি, নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিসহ সংশ্লিষ্ট সকল কর্তৃপক্ষ আন্তরিকতা নিয়ে এগিয়ে আসলে আধুনিক নারায়ণগঞ্জের ধারণা শুধু কাগজ কলমে থাকবেনা, বাস্তবে রূপ নিবে, অবসান ঘটবে নারায়ণগঞ্জবাসীর দীর্ঘ প্রতীক্ষার।
লেখকঃ বহুজাতিক ওষুধ কোম্পানী ও পোশাক শিল্পের সাবেক শীর্ষ কর্মকর্তা।


আপনার মতামত লিখুন :

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *


Theme Created By Raytahost.Com