হাসপাতালগুলোতে ক্রমেই বাড়ছে ডেঙ্গু রোগীর সংখ্যা। দিনের সাথে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে ডেঙ্গুরোগী। জেলার পাঁচ উপজেলার মধ্যে ডেঙ্গু সংক্রমণে সবচেয়ে বেশি প্রভাবিত হয়েছে সদর উপজেলার সিটি কর্পোরেশন অঞ্চল। হঠাৎ জ্বর, শরীর ব্যাথা ও সাথে বমি বমি ভাব হলেই হাসপাতালে ছুটছে নগরবাসী। ডেঙ্গু টেস্ট পজিটিভ হলে কেউ হাসপাতালে ভর্তি হয়ে চিকিৎসা নিচ্ছেন। আবার কেউ চিকিৎসা নিয়ে বাড়িতে অবস্থান করছেন।
নারায়ণগঞ্জ জেনারেল (ভিক্টোরিয়া) হাসপাতাল ও ৩০০ শয্যা হাসপাতালের দেয়া তথ্য অনুযায়ী, অক্টোবর মাসে নারায়ণগঞ্জ শহরে ডেঙ্গু চিকিৎসার জন্য হাসপাতালে ভর্তি হয়েছে প্রায় সাড়ে ৪‘শ জন। এর আগের মাস, সেপ্টেম্বরে হাসপাতালে ডেঙ্গু চিকিৎসার জন্য ভর্তি হয়েছিলেন ১‘শ ৮০ জন।
চিকিৎসকরা বলছেন, ডেঙ্গুর সংক্রমণ নভেম্বর পর্যন্ত আরও বাড়তে পারে। তাই সকলকে সতর্ক হতে হবে, শরীরে জ্বর জ্বর ভাব দেখা দিলে অবহেলা না করে ডেঙ্গু পরীক্ষা নিতে হবে। পরিবারের কারও জ্বর হলে নিকটবর্তী চিকিৎসাকেন্দ্রে নিয়ে ডেঙ্গু পর্রীক্ষা করাতে হবে। ডাক্তারের পরামর্শ ছাড়া কোন রকম ওষুধ সেবন করা উচিত হবে না।
নারায়ণগঞ্জ জেলা সিভিল সার্জন ডা. এ এফ এম মুশিউর রহমান জানান, গতবছরের তুলনায় ডেঙ্গু সংক্রমণের মাত্রা বেড়েছে। শুরুতে আমরা ধারণা করেছিলাম, অক্টোবর আসার আগ দিয়ে ডেঙ্গু সংক্রমণের মাত্রা কমবে। পরিস্থিতি পর্যক্ষেবক্ষণ করে আমরা ধারণা করছি, নভেম্বরের এক-দুই সপ্তাহ পর্যন্ত ডেঙ্গু সংক্রমণ বাড়তে পারে। তবে নারায়ণগঞ্জে ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে কোন রোগীর মৃত্যু হয়নি। আমাদের সকল সরকারি হাসপাতালে ও স্বাস্থ্যসেবা কেন্দ্রে ডেঙ্গু চিকিৎসার জন্য যথেষ্ঠ ব্যবস্থা রয়েছে। আমাদের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, ডেঙ্গুতে সবচেয়ে বেশি প্রভাবিত বা এফেকটেড অঞ্চল হলো সদর উপজেলা। এর মধ্যে ডেঙ্গু সংক্রমণের মাত্রা বেশি সিটি কর্পোরেশন অঞ্চলে।
৩০০ শয্যা বিশিষ্ট হাসপাতালের চিকিৎসা তত্তাবধায়ক (উপ-পরিচালক) ডা. মো. আবুল বাসার বলেন, গত মাসে ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে ভর্তি হয়েছিলেন ৭৮ জন। অক্টোবর মাসে রোগী ভর্তির সংখ্যা দুই শত পেড়িয়ে যাবে। অর্থাৎ, গত মাসের তুলনায় হাসপাতালে প্রায় তিনগুণ রোগী ভর্তি হয়েছে। গত ২৪ ঘন্টায় ১২ জন হাসপাতালে ডেঙ্গু চিকিৎসার জন্য ভর্তি হয়েছেন। আজকে ২৫ জন ডেঙ্গু রোগী হাসপাতালে অবস্থান করছেন।
তিনি আরও বলেন, সকলের উদ্দেশ্যে বলবো বাড়িতে কারও জ্বর হলেই ডেঙ্গু পরীক্ষা করাবেন। এনিয়ে কোন প্রকার অবহেলা করবেন না। এবছর ডেঙ্গুর সংক্রমণ বেড়েছে, তাই আমাদের সকলকে সতর্ক থাকতে হবে। পরিবারের কারও জ্বর জ্বর ভাব দেখা দিলে,গায়ে ব্যাথা থাকলে চিকিৎসকের শরণাপন্ন হবেন। ডেঙ্গু টেস্ট না করে কোন ওষুধ খাবেন না।
নারায়ণগঞ্জ জেনারেল (ভিক্টোরিয়া) হাসপাতালের আরএমও ডা. জহিরুল ইসলাম বলেন, হাসপাতালে গত তিন মাসের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, এ মাসে সবচেয়ে বেশি সংখ্যক রোগী ডেঙ্গু চিকিৎসার জন্য হাসপাতালে ভর্তি হয়েছে। আগস্ট মাসে ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে ১৭ জন হাসপাতালে ভর্তি হয়েছিলেন, সেপ্টেম্বরে ভর্তি হয়েছে ১০২ জন। আর চলতি মাস, অক্টোবরে ভর্তির সংখ্যা ২৫৮ ছাড়িয়ে যাবে। আজকে হাসপাতালে ডেঙ্গু চিকিৎসার জন্য ভর্তি আছেন ৩০ জন, গত ২৪ ঘন্টায় ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন ১৫ জন।
তিনি বলেন, ডেঙ্গু পরিস্থিতি অনেক ভয়ানক হয়ে উঠছে। হাসপাতালে যতজন ভর্তি হয়েছেন, তার চেয়ে বেশি চিকিৎসা নিতে আসছেন। রোগীদের নিয়ে আমাদের প্রায় সকল স্পেস ফিলআপ হয়ে আছে। কেউ ছাড়পত্র নিয়ে বেরিয়ে গেলে সেখানে নতুন করে ডেঙ্গু রোগী ভর্তি হচ্ছেন। অনেকে চিকিৎসা নিয়ে বাড়িতে অবস্থান করছেন। ডেঙ্গু জ্বর শরীরে র্যাশ হয়, বমি হয় ও ব্লাড প্রেসার কমে যায়। তাপমাত্রা বাড়ার জন্য শরীর শুষ্ক হয়ে পানিশূণ্যতা দেখা দেয়। রোগীকে প্রচুর পানি, লেবুর শরবত খেতে হবে। মাথাব্যাথা, অস্বস্তি বেশি হলে ডাক্তারের শরণাপন্ন হতে হবে।
নারায়ণগঞ্জ সিটি কর্পোরেশন অঞ্চলে ডেঙ্গু সংক্রমণ রোধে কার্যকরি পদক্ষেপ নেয়া হচ্ছে বলে জানিয়েছেন সিটি কর্পোরেশনের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা মোহাম্মদ জাকির হোসেন। তিনি জানান, সিটি কর্পোরেশনের ৩৯টি অঞ্চলকে আমরা ডেঙ্গু সংক্রমণের হটস্পট হিসেবে চিহ্নিত করেছি। আমাদের দৈনিক মশকনিধন কাজের পাশাপাশি এই হটস্পটগুলোতে ডেঙ্গু জ্বরের উৎপত্তিস্থল অর্থাৎ, এডিস মশা জন্ম নেয়, এমন অঞ্চলে আমরা কাজ করবো। নোংরা জায়গা পরিষ্কার ও এডিস মশার বাসস্থান দূর করবো।ডেঙ্গুর ৩৯ স্পট
প্রতিনিয়তই বাড়ছে ডেঙ্গু সংক্রমণ জনিত রোগীর সংখ্যা। সরকারি হাসপাতালগুলোতে বাড়ছে রোগীর চাপ, বেড খালি না থাকায় বাধ্য হয়ে ফ্লোরেই চিকিৎসা নিচ্ছেন অনেকে। ডেঙ্গুর এই প্রকোপ ঠেকাতে নানা পদক্ষেপ নিচ্ছে জেলা স্বাস্থ বিভাগ ও নারায়ণগঞ্জ সিটি কর্পোরেশন। সেই ধারাবাহিকতায় ডেঙ্গু মশা জন্ম ও ভাইরাসছড়ায় এমন ৩৯ টি স্থান চিহ্নিত করেছে সিটি কর্পোরেশন। এই স্থানগুলোকে ডেঙ্গুর ‘হটস্পট’ বলে আখ্যা দিয়েছে তারা। সিটি কর্পোরেশন অঞ্চলের চিহ্নিত এই হটস্পট গুলোতেই পরিষ্কার-পরিচ্ছেন্ন অভিযান চালাবে এক মেডিকলে টিম।
সিটি কর্পোরেশনের ৩৯টি হটস্পট হলো, আটিগ্রামের ভাঙ্গাপ্রেস এলাকার ডোবা, মাঠবাড়ি পুকুরপাড় ও তার আশেপাশের ডোবা, সুমিলপাড়া রেললাইনে পাশের ডোবা, ডিএন্ডডি এর খাল, আইলপাড়া এলাকায় বদ্ধডোবা, বাবুরাইল লেকের দক্ষিনের ডোবা, নগর স্বাস্থ্যকেন্দ্র ও হাসপাতালের পূর্বসাইডে পুকরের সাথে ময়লা ফেলার জায়গা, এলএন রোডের ডোবা, নইল্লাপাড়া ডোবা, আলামিন নগর এলাকার ডাম্পিং স্পট, দেওভোগ বড় মসজিদ পাক্কা রোড পুকুর, তল্লা নতুন রোড রেললাইন পুকুর, তল্লা কিল্লারপুর পুকুর, ডাইলপট্টি পরিত্যক্ত প্লট, নগর স্বাস্থ্য কেন্দ্র-৩ আবর্জনাযুক্ত পুকুর, বাজনাপাড়া এর পিছনে পুকুর, উত্তর চাষাড়া রামবাবুর পুকুর পাড়ের পূর্ব দিকে পুকুর, নয়াপাড়া আবর্জনাযুক্ত পুকুর, ডিয়ারা সরদারগলি আবর্জনাযুক্ত পুকুর, সস্তাপুর খাল, ফকিরাপুল খাল, বার একাডেমি আবর্জনা, বি.এম. স্কুল ঘাট আবর্জনা, বায়তুন নূর জামে মসজিদ এর পশ্চিমে ডোবা, ডা. ফাতেমা শিরীন এর বাড়ির পিছনে ডোবা, ভূঁইয়াপাড়া ডোবা ও আবর্জনা, শাশ্মানের পিছনে ডোবা, দাতা সড়ক, মাদ্রাসা গুলি ডোবা, বউবাজার ডোবা, কাজীর দেওয়ানের বাড়ী আবর্জনা, কৃষিপাড়া আবর্জনা নিম্নভূমি আবর্জনা, হিরাঝিল খাল, ডেমরা রোড ৪টি ডোবা, জিউস পুকুর আবর্জনাযুক্ত পুকুর, আমেনা মঞ্জিল পাইকপাড়া আবর্জনা,এল. এন. রোড বদু এর বাড়ি ডোবা, তল্লা বড় মসজিদ ডোবা, চিত্তরঞ্জন খাল ও পানির ট্যাংকি শাহপাড়া খাল।
এ বিষয়ে সিটি কর্পোরেশনের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা মোহাম্মদ জাকির হোসেন বলেন, আমরা ডেঙ্গু প্রতিরোধে কাজ করছি। সিটি কর্পোরেশন এলাকায় প্রায়ই মশা নিধন গ্যাস দিচ্ছি। তবে বিভিন্ন হাসপাতাল কতৃপক্ষের সাথে কথা বলেছি। রোগীদের অবস্থান ও এলাকা পর্যালোচনা করে আমরা সিটি কর্পোরেশন এলাকায় ৩৯ টির মতো স্থান বা স্পট চিহ্নিত করেছি যেখানে ডেঙ্গু মশার জন্ম হচ্ছে এবং সংক্রমন ছড়াচ্ছে। এই স্পটগুলোতে আমাদের বিশেষ টিম যাবে। দৈনিক মশক নিধন কাজের পাশাপাশি এই হটস্পটগুলোতে ডেঙ্গু জ্বরের উৎপত্তিস্থল অর্থাৎ, এডিস মশা জন্ম নেয় এমন অঞ্চলে আমরা কাজ করবো। নোংরা জায়গা পরিষ্কার করে এডিস মশার বাসস্থান দূর করবো। ডেঙ্গুর সংক্রমণ রোধ করতে হলে মশার উৎপত্তি স্থলেও আমাদের কাজ করতে হবে।
গোপনীয়তা নীতি | এই ওয়েবসাইটের কোন লেখা, ছবি, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি।