ফরিদ আহমেদ রবি =
স¤প্রতি মার্কিন রাষ্ট্রদূত দুর্নীতি দমন কমিশন কার্যালয়ে দুদক চেয়ারম্যানের সাথে সৌজন্য সাক্ষাৎ করেন। তিনি দুর্নীতি দমনে বাংলাদেশকে সব ধরণের প্রশিক্ষণ ও প্রযুক্তিগত সহায়তা প্রদানের আশ্বাস দেন। সংবাদটি দেখে বেশ কয়েকটি বিষয় আমার সামনে চলে এলো।
বাংলাদেশে দুর্নীতির বিস্তৃতি, দুর্নীতির রূপান্তরিত ধরণ, দুর্নীতি দমনে আমাদের অসহায়ত্ব, নৈতিকতার চরম অবক্ষয়।
দীর্ঘদিন যাবত বাংলাদেশ দুর্নীতিগ্রস্ত দেশগুলোর তালিকায় শীর্ষস্থানীয় অবস্থান দখল করে রেখেছে। বর্তমানে দুর্নীতিগ্রস্ত দেশগুলোর তালিকায় বাংলাদেশের অবস্থান ১৩তম। এক সময় পরপর কয়েক বছর দুর্নীতিতে আমরা চ্যাম্পিয়নও ছিলাম। সেখান থেকে ১৩তম অবস্থানে আসার জন্য দেশে যেমন কিছু ইতিবাচক কাজ হয়েছে, পাশাপাশি অন্য দেশগুলোতে দুর্নীতির প্রসার বেশি হওয়াতে আমাদের বর্তমান অবস্থান নির্ধারিত হয়েছে। গত বছর যে স্কোর নিয়ে বাংলাদেশ ১২তম ছিল একই স্কোর নিয়ে বর্তমানে ১৩তম অবস্থানে পৌঁছেছে অর্থাৎ অন্য আরেকটি দেশ দুর্নীতির স্কোরে এগিয়ে যাওয়াতেই আমাদের এই প্রাপ্তি! সেক্ষেত্রে একথা অনস্বীকার্য দুর্নীতি দমনে বাংলাদেশ খুব বেশি এগোতে পারেনি। বৈশ্বিক ডিজিটালাইজেশনে আমরা অনেক পিছিয়ে থাকলেও দুর্নীতিতে ডিজিটালাইজেশন অনেকটা শক্তিশালী অবস্থান দখল করে নিয়েছে। প্রথাগত দুর্নীতির জায়গা দখল করেছে ডিজিটালাইজড দুর্নীতি। বিভিন্ন রাষ্ট্রীয় ব্যাংক থেকে টাকা পাঁচার হয়ে যাওয়া তারই প্রকৃষ্ট উদাহরণ। দুর্নীতির ধরণ এবং আধুনিকায়ন রোধ করার পর্যাপ্ত সামর্থ্য আমাদের নেই। তাইতো মার্কিন রাষ্ট্রদূত এমন সহায়তার আশ্বাস দিতে পারেন। বিষয়টি জাতি হিসেবে আমাদের জন্য কতটা গৌরবের? দুর্নীতি দমনে আমাদের অসহায়ত্ব কেন? এর উত্তর কি আমাদের জানা নেই? বড় মাপের সব ধরণের দুর্নীতিতে জড়িত ব্যক্তিগণ সমাজ এবং রাষ্ট্রের নির্দিষ্ট কিছু অবস্থান থেকে উত্থিত । দুর্নীতিগ্রস্ত ২-৪ জন ধরা পড়লে দেখা যায় তাদের অধিকাংশই প্রতিষ্ঠিত ব্যবসায়ী, আমলা, ব্যাংকার, বা প্রশাসনের বিভিন্ন স্তরে কর্মরত কর্মচারী, কর্মকর্তা। এদের বেশিরভাগই তথাকথিত শিক্ষিত সমাজের অংশ। দেশের গরীব চাষী, শ্রমজীবি, সাধারণ মানুষ, দুর্নীতি কাকে বলে জানেনা বললেই চলে অথচ তাদের ঘাম ঝরানো পরিশ্রমে অর্জিত অর্থ নিয়েই যতরকম দুর্নীতির কাজ সম্পন্ন হয়। এরা সমাজে সবচেয়ে উপেক্ষিত, অশিক্ষিত অভিধায় অভিহিত। দুর্নীতিগ্রস্ত ব্যক্তি শুধু দেশের মানুষের ক্ষতিই করে না দেশকেও ক্ষতিগ্রস্ত করে দেশের সম্পদ বিদেশে পাচার করে। দুর্নীতির ক্ষেত্রে বর্তমানে সবচেয়ে আশঙ্কাজনক হচ্ছে দেশের অর্থ বিদেশে পাচার হয়ে যাওয়া, তাই দুর্নীতির অন্যান্য শাখায় প্রতিকার মূলক ব্যবস্থা গ্রহণের আগে প্রয়োজন বিদেশে অর্থ পাচার বন্ধ করা। বিদেশে অর্থ পাচার কারা করছে তাদেরকে চিহ্নিত করার কাজ খুব বেশি কঠিন নাও হতে পারে। ইউরোপ আমেরিকা সহ অনেক উন্নত দেশে কাদের স্হাবর, অস্হাবর সম্পত্তি রয়েছে, সেখানে বাড়িঘর করে কাদের পরিবার পরিজন অবস্থান করছে, কারা নিয়মিত ওই সমস্ত দেশে যাতায়াত করছে, তাদের অর্থ উপার্জনের উৎস এবং ওই সমস্ত দেশে বিভিন্ন স্থাবর, অস্হাবর সম্পত্তি করার উৎস জানতে পারা খুব কঠিন কাজ নয়। এদেশের এক বিশাল জনগোষ্ঠী যখন মাথার ঘাম পায়ে ফেলে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে কাজ করে দেশে বৈদেশিক মুদ্রা পাঠাচ্ছে তখন আরেকটি শ্রেণীর দেশ থেকে টাকা পাচার করে নিয়ে যাওয়া মেনে নেওয়া যায় না। বড় বড় ব্যবসায়ীদের একটি অংশ অধিকাংশ সময় বিদেশেই থাকেন , মাঝে মাঝে দেশে আসেন। তথ্যপ্রযুক্তির কল্যাণে ব্যবসা পরিচালনার জন্য তাদের দেশে থাকাটা খুব বেশি প্রয়োজন হয় না। সরকারি ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের একাংশ অবসরের পরপরই ইউররোপ আমেরিকার বিভিন্ন দেশে পাকাপোক্তভাবে থেকে যাওয়ার ব্যবস্থা করেন। পাকাপোক্তভাবে থেকে যাওয়ার ব্যবস্থা নিশ্চয়ই রাতারাতি হয় না আগে থেকেই সব প্রস্তুতি নেয়া থাকে। এদেরকে চিহ্নিত করে আয়ের উৎস জানা নিশ্চয়ই খুব কঠিন কাজ নয়। দেশে থাকতে যাদের ভাল লাগে না তারা বাইরে গিয়ে থাকতেই পারে কিন্তু দেশের সম্পদ লুট করে নেওয়া কোন অবস্থাতেই ছাড় পেতে পারে না। কানাডার বেগমপাড়া হিসেবে পরিচিত শহরে কারা বসবাস করে, কাদের স্থাবর সম্পদ রয়েছে এ ব্যাপারে বিভিন্ন সময় বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমে অনেক তথ্যই প্রকাশ পায়। অর্থ পাচার ঠেকানো যাদের দায়িত্ব, আশা করি, এসব তথ্য তাদেরও অজানা নয়। দেশের সরকারি অনেক অফিসে কর্মরত পিয়ন থেকে শুরু করে ঊর্ধ্বতন অনেক কর্মকর্তার রাতারাতি ধনসম্পদের মালিক হয়ে যাওয়া চোখের সামনেই ঘটছে। তাদের অর্থ বিত্তের উৎস যে বৈধ নয় তা সাধারণ মানুষ নির্দ্বিধায় বুঝতে পারে কিন্তু করার কিছুই নেই।অর্থবিত্তের কারণে সমাজে এদের প্রভাব প্রতিপত্তি অনেক বেশি। এই শ্রেণীর কর্মচারী কর্মকর্তাদের জবাবদিহিতার আওতায় আনা গেলে দুর্নীতি অনেকাংশেই কমিয়ে আনা সম্ভব। রাজনৈতিক প্রভাব প্রতিপত্তি খাটিয়ে দুর্নীতির প্রসার এদেশে নতুন কিছু নয়। ঠিকাদারি ব্যবসা থেকে শুরু করে বিভিন্ন পর্যায়ে চাঁদাবাজি, টেন্ডারবাজি, মাস্তানি, দুর্নীতি প্রসারের আরো একটি বড় ক্ষেত্র।এসব দুর্নীতিপরায়ণ রাজনৈতিক ব্যক্তিগণ দলের জন্য কোন সুফলই বয়ে আনতে পারেনা তারপরও প্রভাব প্রতিপত্তি টিকিয়ে রাখা এবং অর্থ লাভের মাধ্যম হিসেবে এদের রাজনৈতিক পৃষ্ঠপোষকতা দেয়া হয়। রাজনৈতিক দলগুলোর আন্তরিক সদিচ্ছাই কেবল এ ধরণের দুর্নীতি দমনে সহায়ক ভূমিকা রাখতে পারে। দুর্নীতিবাজদের যেমন কোন নীতি নেই, তাদের দেশপ্রেমও নেই। এদের কাছে নৈতিকতা শুধুমাত্র একটি শব্দ। নৈতিক অবক্ষয়ের নিকৃষ্ট উদাহরণ এ সমস্ত দুর্নীতিবাজ ব্যবসায়ী, আমলা, রাজনীতিবিদ, থেকে শুরু করে সংশ্লিষ্ট সকলের দেশধ্বংসী কার্যক্রম। এদের দেশ ধ্বংসী আচরণ বন্ধ করতে প্রয়োজন হলে উন্নত বিশ্বের আধুনিক প্রযুক্তি সহায়তা নেয়া যেতে পারে তবে তা যেন দীর্ঘমেয়াদী না হয়। দুর্নীতি রোধে আমাদের স্বয়ংসম্পূর্ণ হতেই হবে। পরনির্ভরশীল হয়ে দুর্নীতি রোধ যেমন পুরোপুরি সম্ভব নয় তেমনি জাতি হিসেবে আমাদের জন্য গৌরবেরও নয়। অনেক চড়াই উতরাই পেরিয়ে, অনেক রক্তের বিনিময়ে অর্জিত আমাদের এদেশের স্বাধীনতা সেদিনই পুরোপুরি সার্থক হবে,যেদিন জাতি হিসেবে আমরা দুর্নীতি মুক্ত হতে পারবো।
লেখক : বহুজাতিক ওষুধ কোম্পানি ও পোশাক শিল্পের সাবেক শীর্ষ কর্মকর্তা।
গোপনীয়তা নীতি | এই ওয়েবসাইটের কোন লেখা, ছবি, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি।