Logo
HEL [tta_listen_btn]

মন্তব্য কলাম: তারে ধিক শত ধিক

ফরিদ আহমেদ রবি
মুসলিম বিশ্বে রমজান এক বিশেষ তাৎপর্যময় মাস। মহিমান্বিত এই মাসে সমগ্র মুসলিম বিশ্ব মহান আল্লাহর করুণা, ক্ষমা এবং পারলৌকিক শাস্তি মওকুফের জন্য দিনরাত প্রার্থনায় রত থাকেন। দিনব্যাপী পানাহার থেকে বিরত এবং রাত্রিকালে মহান আল্লাহর নৈকট্য লাভের জন্য বিভিন্ন ধর্মীয় প্রার্থনায় মগ্ন থাকেন। মাসটি ধর্মপ্রাণ মুসলমানদের কাছে অতীব গুরুত্বপূর্ণ এক বিশেষ মাস। রমজানের গুরুত্ব ও তাৎপর্য উপলব্ধি করে অন্যান্য ধর্মাবলম্বীরাও মাসটিকে যথেষ্ট সম্মান দিয়ে থাকে। মুসলিম সমাজ যাতে মাসটি যথার্থভাবে পালন করতে পারে সে ব্যাপারে অন্যান্য ধর্মাবলম্বীরাও সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দেয়। অনেক অমুসলিম দেশ এ মাসে নির্বিঘ্নে ধর্মীয় আচার পালনে মুসলিম জনগোষ্ঠীর পাশে এসে দাঁড়ায়। ধনী গরীব নির্বিশেষে প্রতিটি ধর্মপ্রাণ মুসলমান এ মাসে সাধ্য অনুযায়ী একে অপরের প্রতি সহায়তার হাত বাড়িয়ে দেয়। অর্থবিত্তশালী ধর্মপ্রাণ মুসলমানগণ দান-খয়রাত কয়েক গুণ বাড়িয়ে দেন পূণ্য লাভ এবং গোনাহ মাফের আশায়। প্রতিটি পরিবারে সাধ্যমত ভাল খাবার সহযোগে ইফতারের আয়োজন করা হয়ে থাকে। পূণ্য লাভের আশায় ধনী দরিদ্র নির্বিশেষে রোজাদারদের ইফতার খাওয়ানোর প্রতিযোগিতাও চলে। বিভিন্ন মসজিদে ইফতারের আয়োজন সাধারণত পাড়া মহল্লা থেকেই করা হয়ে থাকে। ইফতার সামগ্রীতে থাকে বিভিন্ন রকমের খাবার যা সচরাচর সারা বছর দেখা যায় না। তাই এই মাসে বেশ কিছু পণ্যের চাহিদা কয়েক গুণ বেড়ে যায়। মুসলিম বিশ্বের বিভিন্ন দেশে এই মাসে রোজাদারদের সুবিধার্থে বেশ কিছু পণ্যের উপর মূল্য ছাড় দেয়া হয় যাতে রোজাদারদের কষ্ট না হয়। ছাড় দেয়ার এ প্রক্রিয়া সরকার এবং ব্যবসায়ী উভয়পক্ষ থেকেই হয়ে থাকে। বিশ্বের বহু দেশে ধনাঢ্য ব্যক্তি এবং ব্যবসায়ীদের পক্ষ থেকে রোজাদারদের সুবিধার্থে বিভিন্ন পণ্য সামগ্রীর মূল্য ছাড় দেয়ার প্রতিযোগিতা শুরু হয়ে যায়। মুসলিম প্রধান বাংলাদেশের দুর্ভাগ্য, এ দেশে তার ছিটে ফোটাও দেখা যায় না। বরং দেখা যায় উল্টো চিত্র। মুনাফালোভী ব্যবসায়ীগণ মুনাফা লাভের সর্বোত্তম সময় হিসেবে এই পবিত্র মাসটিকে বেছে নেয়। তাই তারা সব পণ্যের দাম এই মাসে বাড়িয়ে দেয়। করোনা, রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ, বিশ্ব মোড়লদের অবরোধ পাল্টা অবরোধসহ বিভিন্ন বৈশ্বিক কারণে দেশের অর্থনৈতিক অবস্থা এমনিতেই সবচেয়ে নাজুক অবস্থায় রয়েছে। যার দায় শোধ করতে হচ্ছে এ দেশের নিরীহ সাধারণ নাগরিকদের। দু’বেলা দু’মুঠো অন্ন জোগাড় করতে সাধারণ মানুষের জীবন ওষ্ঠাগত। জীবনযাত্রার মানকে কঠিন থেকে কঠিনতর করে তুলেছে তেল-গ্যাস-বিদ্যুতের বর্ধিত মূল্য। নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য সামগ্রীর দাম লাফিয়ে লাফিয়ে বেড়ে চলেছে। সরকার সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন মহলও মূল্য বৃদ্ধিকে সম্পূর্ণ অন্যায্য বলে ব্যবস্থা নেয়ার ঘোষণা দিয়েছেন। দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণে রাখার জন্য সরকারি মহল থেকে মাঝে মাঝেই বিভিন্ন বাজারে ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা এবং সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে হানা দিতে দেখা যাচ্ছে। বাড়তি দাম রাখার জন্য জরিমানার খবরও প্রায়ই দেখা যায়। ভোক্তা সাধারণের সুবিধার্থে সরকার বেশ কিছু পণ্যের উপর শুল্ক ছাড় দিয়েছে। শুল্ক ছাড় ভোক্তার কোন কাজে আসেনি বরং ব্যবসায়ীরা সেই ছাড়কে নিজেদের মনে করে গিলে ফেলেছে। শুল্ক ছাড় দেয়া পণ্য যদি কম দামে ভোক্তা সাধারণ নাই পেল তাহলে এই শুল্ক ছাড়ের অর্থ কি? ক্রমবর্ধমান এই মূল্যবৃদ্ধি সম্পর্কে সরকারি মহল থেকে হতাশা প্রকাশ করা হয়, দায় চাপানো হয় সিন্ডিকেটের উপর। অথচ ব্যবসায়ী মহল সিন্ডিকেটের অস্তিত্ব আছে বলে স্বীকারই করে না। আন্তর্জাতিক বাজার এবং দেশে উৎপাদিত পণ্যের উৎপাদন খরচ যাচাই করলে দেখা যায়, ব্যবসায়ীগণ একতরফাভাবে দাম বাড়িয়েই চলেছে যেখানে সরকারের কোন নিয়ন্ত্রণ নেই। বাজার নজরদারির সংবাদ প্রকাশিত হলেও সাধারণ মানুষ তার কোন সুফল ভোগ করছে না। অভিযানের কোন প্রভাব বাজারে পড়ছে না। তার মানে দাঁড়াচ্ছে তথাকথিত এই ব্যবসায়ী সিন্ডিকেট সরকারের চাইতেও অধিক ক্ষমতাশালী! এমন অবস্থায় সাধারণ মানুষের প্রশ্ন, সর্ষের মধ্যেই ভূত লুকিয়ে নেই তো? প্রতিকারের আশায় সাধারণ ভুক্তভোগী মানুষ কোথায় যাবে? দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণে সরকারি অসহায়ত্ব, ব্যবসায়ী মহলের বেপরোয়া মনোভাব সাধারণ মানুষকে ক্ষুব্ধ করলেও তাদের করার কিছুই নেই। অর্ধাহারে অনাহারে দিন গুজরান করাই যেন সাধারণ মানুষের ভবিতব্য! অনেক রোজাদারকে অদৃশ্য এই শক্তিশালী সিন্ডিকেটের বিরুদ্ধে অভিশাপ বাণী বর্ষণ করতে দেখা যায়! ভুক্তভোগী সাধারণ মানুষের এই অভিশাপবাণী মুনাফালোভীদের হৃদয়ে সামান্যতম আঁচড় কাটতেও সক্ষম হয় না। ওদের কাছে ন্যায়-অন্যায় বলে কিছুই নেই, ওদের ধর্ম একটাই শুধু মুনাফা। তাইতো সারা বিশ্বে যখন রোজাদারদের সম্মানে কিছু করতে পারাকে বড় অর্জন এবং বিশাল সম্মানের মনে করা হয় তখন আমাদের দেশে এই নরপশু শ্রেণীর মুনাফালোভীদের বিপরীতমুখী আচরণ সত্যি অবাক করার মতো! ওদের এই অসৎ অসভ্য আচরণ অসহায় ভাবে মেনে নিয়ে ধুঁকে ধুঁকে মরা ছাড়া ভুক্তভোগী শ্রেণীর কিইবা করার আছে? যেখানে রাস্ট্রযন্ত্র পর্যন্ত অসহায়! এমন অবস্থায় এই নরপশুদের বিরুদ্ধে সাধারণ মানুষের শুধু একটি বিষয়ই করার আছে, আর তা হচ্ছে তাদের প্রতি ঘৃণা! ঘৃণা! ঘৃণা! এবং চরম ঘৃণা প্রকাশ! কবির ভাষায় ‘তারে ধিক শত ধিক’।
লেখক: বহুজাতিক ওষুধ কোম্পানী ও পোশাক শিল্পের সাবেক শীর্ষ কর্মকর্তা।


আপনার মতামত লিখুন :

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *


Theme Created By Raytahost.Com